‘এক্স-রে’ টেকনোলজি
‘এক্স-রে’ ব্যাপারটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। কোন দুর্ঘটনাতে আঘাতপ্রাপ্ত হাত-পা কিংবা ভেঙে যাওয়া কোন স্থানকে ডাক্তার প্রথমেই যা করতে বলেন সেটি হল ‘এক্স-রে’। ‘এক্স-রে’ রিপোর্টি দেখে ডাক্তার সিদ্ধান্তে আসেন রোগীর কি ধরনের ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। ‘এক্স-রে’ ছাড়া ডাক্তাররা সঠিকভাবে দেহের কোথাও ভেঙে যাওয়া অংশ তে কি হয়েছে আন্দাজ করতে পারলেও সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই বর্তমানে ‘এক্স-রে’ টেকনোলজি খুবই প্রয়োজনীয়।
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক ‘এক্স-রে’ কবে এবং কার মাধ্যমে আবিষ্কার হয়েছিল।
‘এক্স-রে’ প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৯৫ এর ৮ই নভেম্বর, জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেল্ম রন্টজেন এর দ্বারা। তিনি তখন একটি রশ্মি আবিষ্কার করেন পরীক্ষাগারে। এর সঠিক কোন নাম তখন তার মাথায় আসেনি তাই তিনি এর নাম দেন ‘এক্স’ রশ্মি। পরবর্তীতে এটিই ‘এক্স’ রশ্মি বা ‘এক্স-রে’ হিসেবে নামাঙ্কিত হয়।
এই রশ্মি খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এটি আসলে উচ্চশক্তিসম্পন্ন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল ১০ পিকো মিটার থেকে ১০ ন্যানোমিটার। এর কম্পাঙ্ক ৩০ পেটাহার্জ থেকে ৩০ এক্সাহার্জ। এর শক্তি মাত্রা ১২৪ ইলেকট্রন ভোল্ট থেকে ১২৬ কিলোভোল্ট পর্যন্ত। ‘ইউ-ভি’ রশ্মির থেকে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম আবার ‘গামা’ রশ্মির থেকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। এই হলো মোটামুটি ‘এক্স-রে’ রশ্মিটির পরিচয়।
চিকিৎসাক্ষেত্রে এবার একে তৈরি করার পদ্ধতিটি জানা যাক।
‘এক্স-রে’ করাতে গিয়ে আমরা যে ‘এক্স-রে’ মেশিনটি কে দেখি তার মধ্যে মাত্র ৩ টি সার্কিট ব্যবহৃত হয় ‘এক্স-রে’ তৈরি করতে। মেশিনটির গায়ে একটি বড় টিউব লাগানো থাকে। এরমধ্যেই ‘এক্স-রে’ তৈরি হয়। ‘এক্স-রে’ যে ধাতুটি থেকে মূলত তৈরি হয় তা হলো ‘টাংস্টেন’ দ্বারা নির্মিত একটি পাত। এই পাতকে ‘ফিলামেন্ট’ বলে। এই পাতটিকে উত্তপ্ত করলে এর থেকে ‘এক্স’ রশ্মি নির্গত হয়।
এই পাতটিকে উত্তপ্ত করার জন্য অতি উচ্চ তাপমাত্রা প্রদান করা হয়। যা প্রায় ২২০০° ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ফিলামেন্টটি থেকে ‘এক্স’ রশ্মি উৎপন্ন হয়। তা একটি কাঁচের বাক্স থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। যে জায়গায় ‘এক্স-রে’ প্রয়োজন তার সামনে একটি ক্যাসেট রেখে দেওয়া হয়।
এই ক্যাসেটটির মধ্যে ‘এক্স-রে’ ফিল্ম থাকে, এই ফিল্মেই ‘এক্স-রে’ চিত্র ফুটে ওঠে। দেহের উপর ‘এক্স’ রশ্মি পড়ে তা শরীরের সমস্ত পেশী এবং কলাদের ভেদ করে ওই ক্যাসেটে গিয়ে পরে। এরপর ওই ক্যাসেটটি থেকে ‘এক্স-রে’ ছবি তৈরি হয়। এরপর সেই ছবিটি কে ডেভেলপ করে রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
শুধুমাত্র চিকিৎসাক্ষেত্র ছাড়াও আরো বহু কাজে ‘এক্স-রে’র প্রয়োজন হয়। যেমন কোনো কিছু খুঁজতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘এক্স-রে’। শিল্পক্ষেত্রে দেওয়াল এর অবস্থা বুঝতে ‘এক্স-রে’ ব্যবহার হয়ে থাকে।
তবে এই ‘এক্স-রে’ আবার অত্যাধিক পরিমাণে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। অত্যন্ত উচ্চ রেডিয়েশন সম্পন্ন হওয়ার ফলে শরীরের কলা-কোষকে স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দেয়। তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রেও লেড ধাতু দ্বারা নির্মিত কক্ষের মধ্যে ‘এক্স-রে’ প্রদান করা হয়। লেড ধাতু ব্যবহারের কারণ হলো এটি ক্ষতিকারক ‘এক্স’ রশ্মি কে সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে নেয়। যার ফলে এটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। ‘এক্স-রে’ কক্ষে ক্রিয়ারত ব্যাক্তিদেরকেও লেড র্নিমিত অ্যাপ্রোন পরতে হয়। কক্ষটিও তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট হয়।
ক্যান্সার এবং টিউমার কোষকে ধ্বংস করতেও ‘এক্স-রে’ কে অনেক সময় কাজে লাগানো হয়। যদিও এক্ষেত্রে সেই ‘এক্স-রে’র শক্তি অনেক মাত্রায় বেশি হয়। সাবধানতা অবলম্বন না করলে বহু মানুষের অজান্তেই বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই ‘এক্স-রে’ যে কক্ষে হয় তার বাইরে ‘রেডিও অ্যাকটিভ জোন’ বলে লেখা থাকে যাতে যে কেউ এসে প্রবেশ করতে না পারে। আমাদের নিজেদের সচেতনতার সঙ্গেই এই অভয়বাণীটি মেনে চলা উচিত। নয়তো আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনবো।
-সৌরদীপ কর্মকার