জাল, আমাদের জীবন জালেই বন্দী। সংসারের জাল থেকে সম্পর্কের জাল আবার রাজনীতির জাল থেকে অন্তর্জাল। এই জালে জালেই জ্বলে গেলাম কিন্তু আজ যে জালের কথা বলবো; সে জাল কিন্তু আরো মারাত্বক।
হয়তো আপাত ভাবে মনে হতে পারে কি এমন কিন্তু সে জাল আমাদের বাস্ততন্ত্রকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে।
সভ্যতা যত এগিয়েছে মানুষ ততই নিজের স্বাছন্দের জন্যে একটার পর একটা উৎসকে নিজের বশবর্তী করে চলেছে।যার ফল ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম হতে যাচ্ছে।
বেশি দিনের কথাও নয় বিগত এক দেড় দশকে এই জালের রাজত্ব শুরু হয়েছে।
যাদের একটু গ্রাম, শহরতলির দিকে বাড়ি তারা এ জিনিস প্রথম থেকেই দেখছেন। আর শহুরে মানুষেরাও গ্রামে গিয়ে এর দেখা পাবেন। এ হলো সরু অতি সূক্ষ্ম নাইলনের জাল, গ্রামের চলতি কথা বুলেট জাল !
বুলেট জাল কোথায় দেখতে পাবেন ?
দেখতে পাবেন মাছ চাষ হয়, এমন কোনো পুকুর বা জলাশয়ের উপরে এই জিনিস পুরো ছাড়ানো রয়েছে।
কী কারণ এর ?
কারণ আর কিছুই নয়! বাণিজ্যিক লাভ, লোকে খরচ করে পুকুরে মাছ ছাড়েন ; এখন সেই সব মাছেদের বাঁচাতে হবে। যাতে বেশি বেশি করে লাভ হয় ব্যাবসায়। কিন্তু তাতে দু-চারটে মাছরাঙা বক পানকৌড়ি বা অন্য পাখি মরলে ক্ষতি কি !
অবাক লাগছে না ! ব্যাবসায়ী তার লাভের কথা তো ভাববেই।- কী তাই তো ?
আসলে কি জানেন, এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সম্পর্ক হলো খাদ্য খাদকের সম্পর্ক ! আর তার উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে ব্যাস্ততন্ত্র আর ঠিকে আছে পরিবেশ। বক মাছরাঙা এদের মাছ খাওয়া এই সব কিছু এক আন্তঃসম্পর্ক যুক্ত, প্রত্যেকটার সাথে প্রত্যেকটার নিবিড় যোগাযোগ। একটিও বিঘ্নিত হলে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।
যে মাছ চাষি সে তার নিজের মুনাফার কথা চিন্তা করে জাল দিচ্ছেন কিন্তু সেই সূক্ষ্ম নাইলনের জালের কথা তো আর পাখিরা জানে না। তারা উড়ে এসে পুকুরের জলে মাছ খেতে যাচ্ছে, আর তখনই হচ্ছে সমস্যা। জালে জড়িয়ে যাচ্ছে পাখিরা, নাইলনের ধারালো সুতোয় আটকে যাচ্ছে পাখিদের শরীর।
তারা উড়তে চাইছে, তখনই তাদের শরীর কেটে গিয়ে ঐখানেই মৃত্যুই হচ্ছে পাখিদের। পাখিরা তো খাদ্যের জন্যে আসবেই মাছরাঙা বক পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখি তো খাদ্যের জন্যে জলাশয়ের মাছের উপরই নির্ভরশীল। অনেক পাখিই মরে গিয়ে জালে আটকে থাকছে এবং সেখানেই দেহ পচে দুর্গন্ধ ও দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক পাখির মৃত্যু না হলেও ডানাও কেটে যাচ্ছে। এর ফলে পাখির সংখ্যা কমে আসছে, যা সরাসরি বস্তুতন্ত্রে আঘাত করছে। এই রকম চলতে থাকলে মৎসভুক পাখির সংখ্যা ক্রমশ কমে এই সব পাখি লুপ্ত হয়ে যাবে, এমন কি জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির আসাও কমতে শুরু করে।
পাখিদের তো আমি আপনি ডেকে খেতে দেবো না বা সাধারণত দেই না, সুতরাং তাদের খর তাদেরই সংগ্রহ করতে হবে। তাই প্রকৃতির নিয়মেই তারা জলাশয় থেকে মাছ খায়।
শুধু মাছ খায় তা তো নয় সেই সঙ্গে জলের পোকামাকড় কীট খেয়ে মাছ চাষের উপকার করে তারা, এছাড়াও জলের অনেক রকম জৈব আবর্জনাও বিভিন্ন পাখি খেয়ে সাফ করে। পাখিদের জৈব বর্জ্য জলে মিশেও জলের বাস্তুতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু সে সব না ভেবে আমরা শুধু নিজেদের লাভের আশায় পাখিদের রুদ্ধ করছি। তাতে পাখিরা মারা যাচ্ছে !
এই একই জালের ঘটনা দেখা যাচ্ছে, কটি ক্ষেত্রে ফলের গাছ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ বা এমনি বাড়ির ফলের গাছ – সব ক্ষেত্রেই ঐ নাইলনের নীল জাল দিয়ে মুড়ে ফেলে হচ্ছে। কারণ ওই পাখি বাঁদুড় হনুমান ইত্যাদি প্রাণীরা যাতে করে ফল খেয়ে আপনার অনিষ্ট না করতে পারে। এও সেই একই সমস্যা ওরা স্বাভাবিক নিয়মেই ফল খেতে আসছে, আর জালে জড়িয়ে আটকা পড়ছে। কেউ কেউ আহত হচ্ছে,কেউ কেউ আটকা পরে মারা যাচ্ছে। আগে ছোটো বেলায় গরম কালে বাড়ির আম লিচু গাছে দেখতাম দল বেঁধে হনুমান আসতো ফল খেতে, কিন্তু সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। ওরাও আর আসে না।
খাদ্যের অভাবে বা জালে আটকে মারা গিয়ে পাখি বাঁদুড়দের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিস্তার কিন্তু থেমে গেছে। পাখিরা ফল খেয়ে মলের ত্যাগের মাধ্যমে বীজ বহু দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলতো। ফলে বীজের মাধ্যমে সেখানে গাছ জন্মাতো,উদ্ভিদের বিস্তার হতো।
সেটাই থেমে গিয়েছে! আসলে সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতি হচ্ছে। এই জালের মাধ্যমে আমরা লাভ করছি না বরং নিজেদেরই বন্দী করছি। ঘুড়ির মরশুমে দেখা যায় প্রায়ই ঘুড়ির সুতোয় পাখি বাঁদুড় প্রভৃতি মারা যাচ্ছে মূলত চড়ুই পাখি,মানুষও ঘুড়ি সুতোয় আক্রান্ত হয়।
কিন্তু সেক্ষেত্রে আইন রয়েছে,জেল হয় কিন্তু পুকুরে বা ফলের গাছে জাল দিয়ে আটকে পাখি মেরে ফেলার কোনো বিচার হয়না। পরিবেশ বা বন দপ্তর কোথাও এই বিষয়ে কোনো আইন নেই বা শাস্তিমূলক ব্যাবস্থাও নেওয়া হয় না। আসলে পাখি বলেই হয়তো নেওয়া হয় না।
কিন্তু অবিলম্বে আইন প্রণয়ন এবং মাছ চাষিদের ও ফল চাষিদের সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে জাল দেওয়ার ব্যাবস্থা বন্ধ করতে হবে।
এবার হয়তো ভাবতেই পারেন ? চাষি নিজের লাভ দেখবেন না …? নিশ্চয়ই দেখবেন কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করে নয়। সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই পরিবেশ গড়ে ওঠে। একে অন্যর ক্ষতি করে নয়। কাকতাড়ুয়ারা তো ছিলোই পুকুরের মাঝখানে বা পাশের, জমি বা ক্ষেতের মাঝে যা পাখিদের মারতোও না, আহতও করতো না। শুধুই ভয় দেখাতো আর তাতেই কাজ হতো। তাই আমাদের এখন বেশি বেশি করে,সেই সব বিকল্পর কথা ভাবতে হবে।
সত্যি বলতে কি গীতার সেই বাণী “কাজ করে যাও ফলের আশা করো না”- এখন আর কেউ মানি না, তাইই এতো সমস্যা কাজ না করে বা অল্প কাজ করেই বেশি ফলের আশা করলে বিপদ তো হবেই। জালের ব্যবহারও তাই আস্তে আস্তে বিপদ ডেকে আনছে পরিবেশের।
সৌভিক রায়