জলসংকট ও আমরা
২০১৯সালে তামিলনাড়ুর একটা খবর পড়ে আমাদের সকলের চোখ চরকগাছে উঠেছিল। সেখানে পানীয় জলের দাম সোনার দাম ছুঁইছুঁই। তামিলনাড়ুতে বেসরকারি জলের ট্যাংকারের (১২০০০ লিটার) দাম ছিল ১২০০- ১৬০০ টাকা, তার দাম দাঁড়িয়েছিল ৪০০০-৫০০০ টাকা।
সারা ভারতবর্ষ যে আগামীতে প্রবল জলসংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে এই নিয়ে নানান গবেষণাপত্র বের হয়েছে। ফলত দেখা যাবে বৃষ্টি হলে বন্যা আর বৃষ্টির পরেই ক্ষরা। অতিরিক্ত পরিমান সবুজ ধংস এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিই এই জলসংকটের মূল কারন।
সারা পৃথিবীর ১৭% জনসংখ্যার ভারতবর্ষে রয়েছে মোটামুটি বিশ্বের ২.৫% স্থলভাগ আর ৪% মিষ্টি জলের সম্ভার। ১২টি প্রধান ও ৪৬টি মাঝারি নদী ছাড়াও এখানে রয়েছে অসংখ্য পুকুর, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদি যেখান থেকে বছরে গড়ে ৬৯০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল আমরা ব্যবহার করতে পারি।
এর সাথেই আছে ভূগর্ভস্থ জলের বিপুল সম্ভার, বাৎসরিক ব্যহারযোগ্য যে জলের পরিমাণ আনুমানিক ৪৩৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। গড়ে বছরে ৪০০০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বৃষ্টিপাত এই জলের ভাণ্ডারকে রিচার্জ বা পূরণ করার অন্যতম উৎস।
নীতি আয়োগ প্রকাশিত ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৬০ কোটি নাগরিক বর্তমানে মাঝারি থেকে তীব্র জলকষ্টের শিকার, এবং বছরে ২ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র নিরাপদ জলের অভাবে।
সারা দেশে ৭৫% বাড়িতে শুদ্ধ পানীয় জলের কোনো উৎস নেই, ৮৪% গ্রামীণ বাড়িতে নলবাহিত জলের সংযোগ অনুপস্থিত। জলসম্পদ মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী ২০৩০ সালে জলের সার্বিক চাহিদা ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণের দ্বিগুণ হতে চলেছে যা কিনা জল সংকটকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই নীতি আয়োগ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লভ্য জলসম্পদ ও তার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ৯টি ক্ষেত্র এবং ২৮টি সূচকের (ভৌম জল, সেচ ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা, পানীয় জল ইত্যাদি) উপর ভিত্তি করে কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্স নামক একটি পরিগণনা প্রকাশ করে যেখানে গুজরাট সর্বোচ্চ (৭৬) ও মেঘালয় সর্বনিম্ন (২৬) স্কোর অর্জন করে।
উল্লেখযোগ্য যে এই গণনায় পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, জম্মু কাশ্মীর, মনিপুর ও মিজোরাম এর তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বড় শহরগুলিতে জলসংকট বাড়বেঃ
অনুমান করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে বেঙ্গালুরু, দিল্লী, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ সহ দেশের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ার শেষ হয়ে যাবে। আগামি ২০৩০-এর পরে ৪০% নাগরিক শুদ্ধ পানীয় জল পাবেন না।
নাসার গ্র্যাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (GRACE) মিশনে বিশ্বের ৩৪টি অঞ্চলে ১৪ বছর ধরে চালানো পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে জলস্তর নেমে যাওয়ার সত্যতা।
জলের গুণমান সূচকের (World Water Quality
Index)
সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল দেশের প্রায় ৭০% জলের ভাণ্ডার কোন না কোনোভাবে কলুষিত, যার ফলে জলের গুণমান সূচকের (World Water Quality Index) নিরিখে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২০তম। ২১% অসুখ বিসুখের মূল কারণ জল বাহিত সমস্যা।
২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিদ্যুতের গতিতে কমছে ভারতের জলস্তর, প্রতি বছর গড়ে ১০-২৫ মিলিমিটার।
১৯৭০-এ খারিফ চাষের সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১০৫০ মিলিমিটার যা ২০১৬-তে ১০০০ মিলিমিটারের নীচে নেমে গেছে। একইভাবে রবি শস্যের ফলনের বৃষ্টিপাত ১৫০ থেকে কমে হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। বর্ষা চলাকালীন বৃষ্টিপাতহীন দিনের পরিমাণ ও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতবর্ষ বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২৬০ কিউবিক কিলোমিটার।
২০১৮ সালে জাতি সঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট জল সংকট মোকাবিলায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও দেশীয় পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে রাজস্থানের আলওয়ার জেলার দৃষ্টান্ত।
ভারতের ওয়াটারম্যান হিসেবে পরিচিত রাজেন্দ্র সিং-এর উদ্যোগে অসংখ্য ক্ষুদ্র জল সঞ্চয় কাঠামো নির্মাণ যেখানে একইসাথে ১০০০-এরও বেশি খরা আক্রান্ত গ্রামে জলের যোগান দিয়েছে, শুকিয়ে যাওয়া ৫টি নদীকে বাঁচিয়ে তুলেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছে ক য়েক গুণ, ৩৩% সবুজায়ন বৃদ্ধি করেছে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হয়েছে।তাই আসুন, কারো মুখাপেক্ষী না থেকে সামাজিক উদ্যোগে মন দিই সবাই! ফিরিয়ে আনি মাটির সোঁদা গন্ধ!
– সবিতা রায় চৌধুরী