Dr. Opurbo Chowdhury
London, England
পার্কে হাঁটছেন । সঙ্গে কেউ নেই । একা । একটু পরে দেখলেন কেউ একজন পাশ কেটে গেলো । সাথে একটা কুকুর পেছনে পেছনে । কুকুরটি কেমন যেন জোর করে হাঁটছে । হঠাৎ দেখলেন মালিকের পিছ ছেড়ে কুকুরটি ঘাসের মাঠে কি যেন শুঁকছে । একটু পর অবাক হবার পালা । কুকুরটা হঠাৎ করে ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে । সারাজীবন দেখে এলেন গরু-ছাগল ঘাস খায়, কিন্তু কুকুরও যে ঘাস খায় মাঝে মাঝে এই প্রথম দেখলেন । কিন্তু এতো কিছু থাকতে মাঝ মাঝে কুকুর কেন ঘাস খায় ?



শরীর বেঠিক হয়ে গেলে তাকে ঠিক করতে ওষুধের দরকার । আধুনিক বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ যে ওষুধ খায়, তা কৃত্রিম ভাবে ল্যাবে তৈরি করা হয় । কৃত্রিম ওষুদের ব্যবহার দুশো বছরের মাত্র । তার আগে প্রকৃতিই ছিল ওষুধের উৎস । প্রকৃতি ছিল সকল প্রাণীদের ফার্মেসি । ল্যাবে প্রস্তুত কৃত্রিম ওষুধের একই রাসায়নিক উপাদান প্রকৃতির বিভিন্ন উৎসে পাওয়া যায় ।
কিন্তু মানুষ কি করে জানলো অমুক পাতায়, অমুক বাকলে কিংবা গাছের শেকড়ে কিংবা অমুক ফলের রসে শরীর ভালো হয় ?
বিবর্তনে মানুষ ওষুধের ব্যবহার প্রথম শেখে প্রাণীদের কাছ থেকে ! শুনতে আশ্চর্য্য লাগছে, তাই না !
তারমানে প্রাণীরাও মানুষের মতো ওষুধ ব্যবহার করে । এই নিয়েই আজকের গল্প ।
শুরুতে কুকুরের ঘাস খাওয়ার কথা বলেছিলাম । কুকুরের পেটে যখন কোন সমস্যা হয়, বদ হজম হয়, কৃমি থাকে, কুকুররা তখন কিছু ঘাস খায় । কয়েক ঘন্টার মধ্যে হড় হড় করে পায়খানা করে পেট খালি করে ফেলে দ্রুত । কখনো হড় হড় করে বমি করে দেয় । তাতে পেট থেকে জীবাণুগুলো বেরিয়ে আসে দ্রুত । তারমানে, ঘাস হলো কুকুরের হজমি বড়ি !
দেখা গেছে শুধু কুকুর নয়, বিভিন্ন ধরনের পাখি, মাছি, লিজার্ড, হাতি, বানররা শরীর খারাপ হলে প্রকৃতির বিভিন্ন কিছুকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করে ।
প্রাণীরা এটি কিভাবে জানে, সে গল্প বিজ্ঞানের আরেকটি গল্প । সে গল্প অন্যদিন বলবো । তবে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা ওষুধ হিসাবে কি খায় তার গল্প বলা যায় । প্রাণীদের এই বিভিন্ন ধরনের self medication নিয়েও বিজ্ঞানের একটি শাখা আছে । নাম : Zoopharmacognosy !
একটি বানর যখন কলা ছিলে খায়, কলার গায়ে লেগে থাকা আঁশের মতো চামড়ার কিছু সাদা অংশও টেনে উঠিয়ে খায় । যেমনটা আমরা মানুষরাও করি । মাতা বানর থেকে শিশু বানরও সেটা শিখে একই প্রক্রিয়ায় খায় । যেমনটা শিশু আমরাও মা বাবাকে সে ভাবে খেতে দেখে আমরাও খাই । বিবর্তনের এমন ধারাগুলো টিকে থাকে পরম্পরায় এই জন্যে যে – কাজগুলো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সহায়ক ।
নতুন কোনো অভ্যাস কিংবা ব্যবহার কিংবা কোনো একটি খাদ্যের ব্যবহার বেনেফিটেড হলে প্রাণীরাও একই কাজটি বার বার করতে থাকে অভিজ্ঞতটার আলোকে ।
যেমন শিম্পাঞ্জি যখন পেটে কৃমির উপদ্রব অনুভব করে, তখন তারা Aspilia নামের সূর্যমুখী ধরনের ফুলের পাতা খায় । Aspilia বুনো ফুলটি বেশি হয় আফ্রিকার জঙ্গলে । মজার ব্যাপার হলো শিম্পাঞ্জিরা এই ফুলের পাতা সহজে খায় না । আবার যখন খায়, তখন একটা বিশেষ পদ্ধতিতে খায় । শিম্পাঞ্জিরা যখন কোনো গাছের পাতা খায়, তা তারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে ঢুকিয়ে চিবায় । কিন্তু কিছু মুহূর্তে শিম্পাঞ্জিরা Aspilia গাছের কাছে গিয়ে কিছু পাতা নাক দিয়ে প্রথমে শুঁকে, তারপর সব পাতা নয়, দুটো বিশেষ ধরনের পাতা একসাথে হাতে নিয়ে রোল করে গিলে ফেলে । কি অদ্ভুদ ব্যাপার ।
কিংবদন্তি প্রাইমেটোলজিস্ট Jane Goodall তাঞ্জানিয়াতে শিম্পাঞ্জির উপর কাজ করতে গিয়ে এটি প্রথম লক্ষ্য করেন । পরে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পান যে ওই পাতায় thiarubrine-A নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান আছে যা কৃমিনাশক ।
আবার সাথে ঐসব শিম্পাঞ্জির বিষ্ঠা পরীক্ষা করে তাতে কৃমি এবং জীবাণুর সন্ধান পান । সাথে তিনি দেখতে পান যে – লোকাল Tongwe গোত্রের লোকেরা এই পাতার চা খায় পেটে কৃমির উপদ্রব হলে ! এবং সত্যি সত্যি তা কাজ দেয় ! তাহলে শিম্পাঞ্জি মানুষ থেকে শিখেছে কাজটি, নাকি, মানুষ শিম্পাঞ্জিদের দেখে কাজটি শিখেছিল !
ভালুক এবং হরিণরাও জীবাণু আক্রান্ত হলে বিশেষ ধরনের পাতা খায় । তাতে তাদের শরীর দ্রুত সেরে ওঠে, আবার নরমাল জীবন শুরু করে ।
প্রকৃতি প্রাণীদের ডাক্তারখানা । বিভিন্ন ধরনের প্লান্টস উৎসগুলো প্রাণীদের মেডিসিন ।
লিজার্ডকে কোনো বিষাক্ত সাপে কামড়ালে দেখা গেছে সাপের বিষ থেকে রক্ষা পেতে এক বিশেষ ধরনের গাছের শেকড় খায় তারা । সাপুড়েদের কাছে কিছু শেকড়ের সন্ধান আছে ! এই শেকড়ের কথা জানতে পেরেছে তারা প্রাণীদের কাছ থেকেই !
Monarch Butterfly । বাংলাকরণ করলে দাঁড়ায় রাজা প্রজাপতি । মাঝে মাঝে এই ধরনের প্রজাপতিগুলো মারাত্মক কিছু প্যারাসাইটে আক্রান্ত হয় । দেখা গেছে যে – শুধুমাত্র এমন আক্রান্ত হলে প্রজাপতিগুলো Milkweed জাতের কিছু গাছে পাতায় লার্ভার জন্ম দেয় । প্রজাপতিদের লার্ভাকে বলে caterpillars । মানে বাচ্চা প্রজাপতি । অন্য সময়ে অন্য গাছের পাতার উপর caterpillars দের জন্ম হলেও কেন মাঝে মাঝে Milkweed গাছের পাতার উপর বংশ বিস্তার করে ? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন Milkweed গাছের পাতায় cardenolides নামের একটি বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান থাকে ।
Cardenolides একধরনের Cardiac glycoside স্টেরয়েড । মানুষের জন্যে যেমন বিষাক্ত, তেমনি এটি প্রজাপতিকে আক্রান্ত করা প্যারাসাইটকেও মেরে ফেলে । প্রজাপতিরা যখন বুঝতে পারে এমন প্যারাসাইট আক্রান্ত, তখন খুঁজে খুঁজে এই বিশেষ ধরনের গাছের পাতায় গিয়ে লার্ভা ছাড়ে । বাচ্চাগুলো ইনফেকশন থেকে বেঁচে যায় ! শুনতে কি অদ্ভুত লাগে তাই না ! পাতাগুলো যেন প্রজাপতিদের হাসপাতাল !
ইথিওপিয়ায় একধরনের বেবুনদের লক্ষ্য করে দেখা গেছে পেটে Flatworm জাতীয় কৃমি হলে একধরনের পাতা খায় । পাতার ভেতর থাকা রাসায়নিক পদার্থটি কৃমিনাশক ওষুধ হিসাবে কাজ করে ।
পাখিরা যখন কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, শরীরে পিঁপড়া ডলে, পিঁপড়ার বাসা ভেঙে পিঁপড়া না খেয়ে পালকে, শরীরে পিঁপড়াকে উঠতে দেয় ।
তখন পিঁপড়া কামড় দিলে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয় । Formic acid । ল্যাটিন Formica মানে Ant ! এখন খাবারের Preservative হিসাবে ফরমিক এসিড ব্যবহার করা হয় । এটার আরেকটি গুন্ হলো আন্টি ব্যাকটেরিয়াল ! পিঁপড়া কামড়ালে পাখিদের শরীরে এই ফরমিক এসিড জীবাণুদের মেরে ফেলে ! তারমানে পিঁপড়া হলো পাখির মলম ! প্রায় দুইশ প্রজাতির পাখিরা এমন করে ।
Red Macaws প্রাণীদের পেটে ব্যাকটেরিয়া কিংবা কোনো প্যারাসাইটের উপদ্রব শুরু হলে তারা একধরনের বিশেষ মাটি খায় । কিন্তু অন্য সময় এই মাটি কখনো খায় না তারা । মাটিতে থাকা রাসায়নিক উপাদানটি এন্টিবায়োটিকসের কাজ করে !
আফ্রিকার কিছু হাতি প্রেগনেন্ট সময়ে কিছু গাছের পাতা খুঁজে । বিশেষ করে Starflower নামের একধরনের গাছের পাতা । যখন লেবার পেইন উঠে, তখন এই গাছের পাতা খায় । তাতে ইউটেরাসের সংকোচন ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে প্রসব সহজ করে । তাহলে বলা যায় Starflower হলো হাতিদের ধাত্রীমা !
মাদাগাস্কারে কিছু লেমুর আছে, প্রেগনেন্সির সময় জীবাণু আক্রান্ত হলে কিংবা শরীরকে ভালো রাখতে, কখনো মাতৃদুগ্ধ তাড়াতাড়ি সিক্রেট শুরু হতে ডুমুর এবং তেঁতুল গাছের পাতা খায় ।
ইন্দোনেশিয়ায় একধরনের ওরাংওটাং আছে, যারা Dracaena cantleyi গাছের পাতায় থুতু লাগিয়ে তা শরীরের হাতে পায়ে ঘষে । বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখতে পেলো ওই গাছের পাতায় একধরনের কেমিক্যেল থাকে যার আন্টি ইনফ্লামেটরি ইফেক্ট আছে । ওরাংওটাং শরীরে কোনো ব্যথা অনুভব করলে এমন পাতা ঘষে শরীরে । স্থানীয় আদিবাসীরাও এমন পাতা খায় শরীরে বা হাড়ের কোনো ব্যথা নাশক ওষুধ হিসাবে । বলা যায় Dracaena হলো ওরাংওটাংদের প্যারাসিটামল ।
প্রাণীদের এমন কিছু খাওয়া আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমাজন অঞ্চলের আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে জানতো ! কারণ তারা প্রাণীদের কাছ থেকেই শিখেছে প্রাণীদের লক্ষ্য করে । কিন্তু আধুনিক মানুষরা এসব গভীরভাবে জানতে শুরু করে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাত্র । আদিবাসীরা যা হাজার হাজার বছর আগেই জানতো, আধুনিক মানুষ তা জানতে পারলো ষাট বছর আগে মাত্র !
সূত্র
1. PNAS : Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America
2. BBC Science Focus
3. BAVH : British Association of Veterinary Herbalists
4. Animal origins of herbal medicine : Michael A. Huffman
5. OA Publishing: Useful plants for animal therapy by M Laudato
© অপূর্ব চৌধুরী । চিকিৎসক এবং লেখক। জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড ।