ব্যর্থতার গন্ধ
গ্রামের বাড়ি এসেছি দিন দুই হবে । বাড়িতে দেখলাম বেশ দেখতে অচেনা একটা পাখি দড়ি দিয়ে উঠানের বেঁটে নিম গাছটার কাছে বাঁধা । পাখিটা আমাকে দেখে ঝটপটানি শুরু করে আবার থেমে গেল – আর বাতাসে একটা বুনো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল – সাথে চেনা সেই ব্যর্থতার গন্ধটাও । ও মা , এই পাখিটা কোথায় পেলে ? আর এখানে ও বাঁধা কেন ? মা রান্না ঘর থেকে মুখ বাড়াল । ওটা তো মাঠের দিকের শেষ বাড়িটার বউটা দিয়ে গেল তোর জন্য, তোকে ওরা খুব ভালোবাসে । রাতে বেশি করে আলু দিয়ে রান্না করে দেব – খেয়ে দেখিস দারুণ খেতে । কিন্তু ওরা একে পেল কোথায় ? আবার রান্না ঘর থেকে ভেসে এল – ওরা তো রোজ রাতে ক্ষেতে জাল পেতে রাখে – প্রতিদিনই কিছু কিছু পাখি জালে আটকা পড়বেই ।
ঝুঁকে পড়া ছাদ
মানুষ একমাত্র জীব যাদের ডি.এন.এ প্রতিদিন অশিক্ষিত হচ্ছে – মানুষ বাদে প্রতিটি জীবই প্রকৃতির নিজস্ব জীবনধারনের নিয়মকানুন মেনে চলে – প্রতিদিন আরো বেশি অশিক্ষিত হতে থাকা মানুষ এতটা পিছিয়ে পড়েছে যে প্রকৃতির নিজস্ব সুর ধরার মতো গভীরতা আর নেই – ফলে মহাবিশ্বে তার একমাত্র সম্বল , একমাত্র ঘর পৃথিবীকে প্রতিদিন হাত ছাড়া করে ফেলছে – আর হয়ত মাত্র ৫০ বছর – তারপর ৮০০ কোটি মানুষ পরিণত হবে চিরকালীন রিফিউজি । মানুষ এতটা অসভ্য যে পৃথিবী থেকে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে জীব প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে আর তার সাথে পৃথিবী ছাদ থেকে একটি খুঁটো খসে পড়ছে , ছাদটাও দিনে দিনে মাথার দিকে ঝুঁকে আসছে তবু মানুষের হুঁশ নেই ।
ডিপ্রেশন
সম্প্রতি আমাদের একটি পরিবেশ সম্মেলনে গিয়েছিলাম । বিগত তিন বছরে কম করে এরকম ৩০টি সভায় গিয়েছে । প্রতিটি সভার আগেই দুই একজন উৎসাহী পরিবেশকর্মী দুই তিন শ’ মানুষকে কল করেন সভায় যোগ দেওয়ার জন্য – শেষে বেশি হলে ৪০ জন যোগ দেন – বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ২০র বেশি হয় না । প্রতিটি সভার আগেই খুব বড় একটা পরিকল্পনার কথা ভাবা হয় । কিন্তু সভাতে দেখা যায় মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে সকলেই কিছু হিডেন এজেন্ডা নিয়ে আসে । সভাতে যে যার মতো নিজের কাজের গুণকীর্তন করে যায় – যে বোকা – সরাসরি , যে চালাক – ইনিয়ে বিনিয়ে ; কেউ কেউ আবার বাণিজ্য সেরে নেয় । ফলে এক সময় ৫টা বেজে যায় – কোন পরিকল্পনার সিদ্ধান্তে আশা যায় না – টোটোতে বসে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় কেন এলাম, সময়টা নষ্ট হল – কেমন একটা হতাশ হতাশ লাগে – আরো একটা ঘন্টা এগিয়ে যায় – খসে পড়ে আরো একটা খুঁটো ।
ধৃতরাষ্ট্র
একটু সকালেই ঘুম থেকেই উঠেছি । একটা ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার কথা , ফ্ল্যাটের দালাল বলেছে – দাদা জঙ্গলের মধ্যে কলকাতা পাবেন – ফ্ল্যাটের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এয়ারপোর্ট , টোটো পথে স্কুল-কলেজ , হাঁটা পথে মালিটিপ্লেক্স-শপিং মল – দক্ষিণের জানালায় বিরাট জলাশয় – পূবের জানালায় আম কাঁঠালের জঙ্গল । দাদা এমন আর পাবেন না , ফ্ল্যাট ডেভলপারের উপর মহলে হাত না থাকলে এরকম জায়গায় ক্লিয়ারেন্স পাওয়াই যায় না । আপনি যা পরিবেশ ভালোবাসেন , এরকম জায়গা মিস করলে পরে আফশোস করবেন ।
নিম গাছটার কাছে দেখলাম পাখিটা এখনো বাঁধা আছে । এখন আমাকে দেখেও চুপ করে রইল ও । ওর কাছে এগিয়ে গেলাম – কাছে বসলাম । তবুও ও চুপ , একটুও নড়ল না , একটু ফিরেও তাকাল না । ধীরে ধীরে ওর পায়ের বাঁধন খুলতে লাগলাম আর চোখটা যেন ঝাপসা হয়ে গেল – বিলের পর বিল বুজিয়ে আমাদের জন্য বড় বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে – সেরকমই কোন একটা বাড়িতে একটা পরিবেশ সম্মেলন বসেছে – একজন স্লাইড শো দেখাচ্ছে – কোন এক বিলের বিলুপ্তপ্রায় সব পাখি ।
পথ
পাখিটা সাইবেরিয়া পোঁছাতে পেরেছে কিনা জানি না – হয়ত অন্য কোন মাঠের অন্য কোন শেষ বাড়ির বউটা তার স্বামী সন্তানের জন্য বেশি আলু দিয়ে ঝোল ঝোল করে রান্না করছে । যে বউটা আমার জন্য পাখিটা দিয়ে গিয়েছিল তাকে গিয়ে আমার পরিবেশের জ্ঞান ঢেলে আসতে পারিনি , তারাও আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না – যখন বিলের ধারের ফ্ল্যাটটা কিনে প্রতি রবিবার খাসির মাংস আর বুধবার কয়লার মুরগি খাবো – তত দিনে বউটার জালে আর পাখি বাঁধবে না – সয়াবিনের ভিতর খুঁজতে থাকবে মাংসের গন্ধ ।
রাহুলদেব বিশ্বাস
পরিবেশ কর্মী