আইজ্যাক আসিমভ – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান লেখক।
************************************************************************
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন , “সায়েন্স ফিকশন হল আধুনিক জগতের রূপকথা“ ।
প্রাচীন রূপকথা গুলো যেমন মানব মনের কল্পনা প্রসূত তেমনি সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানও তাই। পার্থক্য শুধু সায়েন্স ফিকশন বিজ্ঞান কে ভিত্তি করে মানব মনের কল্পনা! আর তাই কল্পবিজ্ঞানকে আধুনিক জগতের রূপকথা বলা যথার্থ।
আধুনিক জগতের এই রূপকথার সবচেয়ে বড় কথক হলেন আইজ্যাক আসিমভ। বলা হয়ে থাকে আইজ্যাক আসিমভ হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান লেখক। আর এজন্যই তাকে বলা হয়, ‘গ্র্যান্ডমাস্টার অফ সায়েন্স ফিকশন।’ সম্পূর্ণ অবাস্তব এক জগৎকে পাঠকের কাছে বাস্তব করে তোলার এক অসামান্য ক্ষমতা ছিল আইজ্যাক আসিমভের।
তাঁর জন্মদিনে প্রতি বছর ২ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘সায়েন্স ফিকশন ডে’ পালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাখো কল্প বিজ্ঞান প্রেমী আনন্দ ও উৎসাহের সাথে পালন করে এ দিনটি।
২ জানুয়ারিতেই সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশন লেখক আইজ্যাক আসিমভ জন্মেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার এক ছোট্ট গ্রাম পেত্রোভিচিতে। আর তার জন্মদিন উপলক্ষেই এই দিনটিকে ‘সাইন্স ফিকশন ডে’ হিসেবে পালন করা হয়।
বর্তমান পৃথিবীতে কল্পবিজ্ঞান অর্থ্যাত সায়েন্স ফিকশন প্রেমীর সংখা কম নয়। কিন্তু সায়েন্স ফিকশনের উৎপত্তি বা শুরুর দিকের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট কোন তথ্য নেই কারো কাছেই। কেউ কেউ মনে করেন সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার গিলগামেশ ছিল প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক রচনা বা সাহিত্য। তবে এর বিরোধিতা করেছেন অনেকেই।
অধিকাংশ বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নিছক কল্পনা নয়, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখা যেতে পারে কেবল প্রকৃত বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই। বিজ্ঞানের সাথে মানব মনের কল্পনা মিশেই এক একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জন্ম। সে বিবেচনায় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবোত্তর যুগেই বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর উৎপত্তি।
আইজ্যাক আসিমভ ১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি সোভিয়েত রাশিয়ার সেই ছোট্ট গ্রাম পেত্রোভিচিতে জন্মগ্রহণ করেন। ৩ বছর বয়সে বাবা মার সাথে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। বড় হয়েছেন নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে।
তার পরিবারের সবাই ইদিশ এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলার কারণে আসিমভ রাশিয়ান বংশোদ্ভূত হলেও কখনো রাশিয়ান ভাষা শেখেন নি। ইদিশ এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সমান পারদর্শিতা ছিল তার। মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই নিজে নিজে পড়তে শিখে যান।
ব্রুকলিনে তার পরিবার একটা দোকান চালাত। সেই দোকানে বাবার সাথে আসিমভকেও কাজ করতে হত। দোকানে অন্যান্য জিনিসের সাথে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও বিক্রি হত। আসিমভ সেগুলো পড়তে শুরু করেন। এবং প্রেমে পড়ে যান এসবের। শুরু করেন লেখালেখি।
মাত্র ১১ বছর বয়সেই তার লেখালেখির হাতে খড়ি। লেখালেখির পাশাপাশি সেগুলো তিনি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বিক্রি করতে শুরু করে দেন অল্প বয়সেই। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’ ম্যাগাজিনে। সেই যে লেখালেখির শুরু তা আর শেষ হয় নি। অপ্রতিরোধ্য গতিতে লিখে গেছেন আজীবন ।
আইজ্যাক আসিমভ নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিন বয়েজ হাই স্কুল এ পড়াশোনা শুরু করেন। পরে ১৯৩৯ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এখান থেকেই ১৯৪৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরই মাঝে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রসায়নবিদ হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন।
ফিলাডেলফিয়া নেভি ইয়ার্ডের ন্যাভাল এয়ার এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনে সিভিলিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন এসময়। যুদ্ধের পর তাকে মার্কিন সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। টাইপিংয়ে বিশেষ দক্ষতার জন্য তিনি দ্রুতই পদোন্নতি পেয়ে কর্পোরাল হন। ১৯৪৬ সালে বিকিনি প্রবাল প্রাচীরে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের সময় সুকৌশলে নিজেকে সরিয়ে নেন। মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে সম্মানজনক অবসর প্রদান করা হয় তাকে।
ডক্টরেট শেষ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন তিনি। এখানেই কর্মরত ছিলেন অনেকদিন। শিক্ষকতার পাশাপাশি পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
ধীরে ধীরে শিক্ষকতার প্রতি ঝোঁক কমে আসে তার। শিক্ষকতা জীবনে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার লেখার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে জৈব রসায়নের পূর্ণ অধ্যাপক পদ প্রদান করে।
আইজ্যাক আসিমভ তার বিশ্ববিখ্যাত সায়েন্স ফিকশনগুলোর জন্য অমর হয়ে থাকলেও সায়েন্স ফিকশন থেকে শুরু করে, ফ্যান্টাসি, মিস্ট্রি, ইতিহাস, নন-ফিকশন, এমনকি বেশ কিছু হিউমার আর স্যাটায়ারও লিখেছেন তিনি।
তার লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০০! যার মধ্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে তার ‘ফাউন্ডেশন’ ও ‘রোবট’ সিরিজের বই গুলো। আইজ্যাক আসিমভের ‘গ্র্যান্ড মাস্টার অব সাইন্স ফিকশন’ হয়ে উঠবার পিছে বড় ভূমিকা এই ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজের।
এ সিরিজের প্রথম বই ফাউন্ডেশন প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে, এরপর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়, ফাউন্ডেশন এন্ড দি এম্পায়ার ও দি সেকেন্ড ফাউন্ডেশন। এই তিনটি বইকে একত্রে বলা হয় ফাউন্ডেশন ট্রিলজী।
এটিই অরিজিনাল ফাউন্ডেশন সিরিজ। এরপর প্রায় ৩০ বছর তিনি এই সিরিজ নিয়ে আর এগোননি। কিন্তু পাঠকদের অনুরোধে বাধ্য হয়ে ৩০ বছর পর এই সিরিজের আরো ৪টি বই লেখতে বাধ্য হন তিনি। ৮০ এর দশকে প্রকাশিত হয় ফাউন্ডেশন্স এজ, ফাউন্ডেশন এন্ড দি আর্থ, প্রিলিউড ট্যু ফাউন্ডেশন এবং ফরোয়ার্ড দি ফাউন্ডেশন।
এই ৭টি বই নিয়েই মূলত ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ। আইজ্যাক আসিমভ তার ফাউন্ডেশন সিরিজের প্রথম তিনটি খন্ড (ফাউন্ডেশন,ফাউন্ডেশন এন্ড এম্পায়ার এবং সেকেন্ড ফাউন্ডেশন) নিয়ে গঠিত ‘ফাউন্ডেশন ট্রিলজি’ ১৯৬৬ সালে ‘বেস্ট অল টাইম সাইন্স ফিকশন সিরিজ’ হিসেবে দ্য ওয়ার্ল্ড সাইন্স ফিকশন কনভেনশন থেকে ‘হুগো এওয়ার্ড’ লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে ‘সাইন্স ফিকশন রাইটার্স এসোসিয়েশন অব আমেরিকা’ তাকে ‘গ্র্যান্ড মাস্টার জিবি সায়েন্স ফিকশন’ সম্মানে ভূষিত করে।
ফাউন্ডেশন সিরিজের মূল পটভূমি হলো ফার্স্ট গ্যালাকটিক এম্পায়ার। প্রায় ২৫ মিলিয়ন তারা নিয়ে এর ব্যপ্তি অনেকটা সৌরজগতের ন্যায়। এর জনসংখ্যা অকল্পনাতীত যা কোয়াড্রিলিয়নে হিসাব করতে হয়।
প্রায় ১২ হাজার বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত এ সাম্রাজ্যকে বলা হত মানবসভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। ধারণা করা হত কোনো কিছুই এর পতন ঘটাতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এম্পায়ার এর অকল্পনীয় উন্নত সভ্যতায় মরচে পরা শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলো এর ধ্বংসের সময়কাল।
আর এই নির্মম সত্যটি প্রথম উপলব্ধি করতে পারেন এম্পায়ার ‘হ্যালিকন রাজ্যের গণিতবিদ হ্যারি সেলডন। ৩০ বছর বয়সে ল্যাবটারীতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে নেহাৎ মজা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ইকুয়েশন নিয়ে একটি হাইপোথিসিস প্রতিষ্ঠার সময় তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন ‘সাইকোহিস্টোরি’।
যার সাহায্যে শেলডন হিসাব নিকাশ করে দেখতে পেলেন যে, এই বিশাল এম্পায়ারের আয়ু আছে আর মাত্র ৩০০ বছর। তারপর আর অস্তিত্ব থাকবে না এই বিশাল সাম্রাজ্যের। ৩০ হাজার বছরের এক অন্ধকার যুগ নেমে আসবে পুরো মানব জাতির উপরে।
বিশাল সাম্রাজ্য ও মানবজাতি রক্ষায় হ্যারি সেলডন তৈরি করলেন ‘সেলডন প্ল্যান’। সেলডন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা গেলে ৩০ হাজার বছরের অন্ধকার যুগ মাত্র ১ হাজার বছরেই শেষ হবে। আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের স্থানে মাথা তুলে দাঁড়াবে এক নতুন শক্তিশালী সম্রাজ্য।
শেষ পর্যন্ত সেলডন প্ল্যান কি সফল হয়? আসলেই কি হ্যারি সেলডন পেরেছিল মানব সভ্যতা কে রক্ষা করতে? এরই উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় আইজ্যাক আসিমভের ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজে।
ফাউন্ডেশন সিরিজের পাশাপাশি আইজ্যাক আসিমভের আরো দুটো বিখ্যাত সিরিজ হচ্ছে এম্পায়ার সিরিজ আর রোবট সিরিজ। সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিচরণ ছিল তার। বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্পও।
তার অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে ‘নাইটফল’ গল্পটিকে ‘সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা’ ১৯৬৪ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বিষয়ক ছোটগল্পের সম্মানে ভূষিত করে। ছোটদের জন্য ও রয়েছে তার অনেক লেখা। ‘পল ফ্রেঞ্চ’ ছদ্মনামে তিনি লিখতেন ছোটদের জন্য। অসংখ্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জনক হলেও তিনি ছিলেন মানবতাবাদী।
তিনি আমেরিকান হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নামে পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় ‘৫০২০ আসিমভ’ গ্রহাণু, ‘আসিমভ্স সাইন্স ফিকশন সাময়িকী’। এছাড়াও আইজাক আসিমভ এর নামে একাধিক পুরস্কারের নামকরণ করা হয়।
আইজ্যাক আসিমভ তার আত্মজীবনী লিখে গিয়েছেন। তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনী। আইজ্যাক আসিমভের ক্লসট্রোফিলিয়া ছিল অর্থাৎ তিনি ছোট আবদ্ধ স্থানে থাকতে ভালবাসতেন। তার আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি সেটা উল্লেখ ও করে গেছেন। তিনি ছোটবেলায় এমন একটি ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন যা নিউ ইয়র্ক সিটি সাবওয়ে স্টেশনে অবস্থিত এবং যেখানে তিনি নিজেকে আবদ্ধ রেখে চলমান ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবেন।
আইজ্যাক আসিমভের উচ্চতা ও উড্ডয়ন ভীতি ছিল। তিনি বিমানে চড়তে চাইতেন না। আর এজন্য দূরে কোথাও যেতেন ও না যেন বিমানে চড়তে না হয়। জীবদ্দশায় মাত্র দুবার বিমানে চড়েছেন তিনি। জীবনের শেষ সময়গুলোতে তিনি সমুদ্র ভ্রমণে অনেক সময় বের করেন। তিনি প্রমোদ জাহাজে করে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন খুব। একজন লেখক পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি অসাধারণ জনপ্রিয় বিনোদন ব্যক্তিত্ব এবং বক্তা ছিলেন। তার সময় জ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। কখনও ঘড়ি না দেখেও প্রায় নিখুঁত সময় বলে দিতে পারতেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভ ১৯৯২ সালের ৬ ই এপ্রিল মারা যান । এ প্রজন্মের পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝেও তিনি বেঁচে থাকবেন তার অসাধারণ সব লেখনীর মাধ্যমে।
তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই 🙏
পঞ্চানন মন্ডল 
তথ্য সূত্রঃ
https://www.britannica.com/biography/Isaac-Asimov