লেখকঃ পঞ্চানন মন্ডল
পরিবেশ দূষণ
চাই দূষণ মুক্ত পৃথিবী
৫জুন : বিশ্ব পরিবেশ দিবস কি ও কেন ?
১৯৭২ সালের জুন মাসের ১ম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশ শীর্ষক আন্তর্জাতিক স্টকহােম কনভেনশন থেকে ৫ জুন দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
ঐ কনভেনশনে ২৬টি অনুচ্ছেদের প্রত্যেকটিতে মানুষের জীবন, জীবিকা ও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্নে পৃথিবীর জল, বায়ু, মাটি, খনিজ উৎস ও বনাঞ্চল প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ তথা পরিবেশের উপর প্রতিটি মানুষের সম-অধিকারকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে।
অংশগ্রহণকারী পৃথিবীর প্রায় সবদেশই নিজ নিজ দেশে এই অঙ্গীকার করেছিল। অথচ ১৯৭২ এর ৩৭ বছর পরও পরিবেশ সমস্যাগুলি ক্রমশ বেড়েই চলেছে, অথচ সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ভাবনা যে হয়নি, একথা বলা যাবে না, গবেষণাপত্র থেকে শুরু করে বড় বড় সেমিনার কনফারেন্স আরাে কত না কি।
পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে ভারতীয় এক বিজ্ঞানী রাজেন্দ্র পচৌরী তাে নােবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন। অথচ পরিবেশের তাপমাত্রা কি কমছে? বা কার্যকরী কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ সমস্যা ও সমাধানের জন্য কয়েকটি দিক উল্লেখ করছি।
জলদূষণ ও তার প্রতিকার
পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ
জলাভূমি সংরক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা
প্লাস্টিকের বিপদ ও বিকল্প
মৃত্তিকা ও বায়ু দূষণ
খরা বন্যা সমস্যা।
ওজোন স্তরের ক্ষয় ও তেজস্ক্রিয় দূষণ
অ্যাসিড বৃষ্টি
তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন
বিষয়গুলি নিয়ে এখানে আলােকপাত করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস
সর্বস্তরের মানুষ এই বিজ্ঞান মনস্কতা প্রসার প্রবন্ধটি থেকে পরিবেশ সমস্যাগুলি বুঝতে পারবেন।
জলদূষণ ও তার প্রতিকার
-
পানীয় জলের গুণাগুণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আন্তর্জাতিক স্তরে নিম্নলিখিতভাবে পানীয় জলের গুণাগুণ নির্দিষ্ট করেছেন।
- ক) বর্ণহীন
- স্বচ্ছ গন্ধমুক্ত,
- pH6.5 থেকে 7.5 ক্ষারতা
- সর্বোচ্চ 600p.p.m,
- লােহা1p.p.m,
- ক্লোরাইড1000p.p.m.,
- কলিফর্ম টোটাল কাউন্ট প্রতি 100 মিলি মিটারে সর্বোচ্চ10।
- খ) দ্রবীভূত কঠিন (পদার্থ সর্বোচ্চ)
- ক্যালসিয়াম 200p.p.m.,
- ম্যাগনেসিয়াম 30p.p.m,
- জিঙ্ক 15p.p.m,
- কপার 1.5p.p.m,
- ম্যাঙ্গানিজ 0.3p.p.m,
- অ্যালুমিনিয়াম 0.2p.p.m,
- (ক্রোমিয়াম, সীসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম 0.01 p.p.m.),
- পারদ 0.001p.p.m,
- সালফেট, নাইট্রেট, ফ্লোরাইড যথাক্রমে এবং 10 p.p.m.।
- সায়ানাইড, খনিজতেল ও ফেনল জাতীয় পদার্থ না থাকাই কাম্য।
- গ) ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য মুক্ত ক্লোরিন 0.5 মি.গ্রা/লিটার থাকতে পারে।
ঘ) নিরাপদ পানীয় জলে মােট কলিফর্ম কাউন্ট 0 হবে। -
শরীরে জলের প্রয়ােজনীয়তা
- আমাদের শরীরের অন্যতম উপাদান হল জল। জল আমাদের শরীরের ভিতরের অংশগুলি ভিজে রাখে। দেহের তাপমাত্রা ও বিভিন্ন তরল (রক্ত ও লসিকা)সান্দ্রতা বজায় রাখে। জল মূত্র ও নিশ্বাসের সাহায্যে বিষ ও বর্জ্য পদার্থ দেহ থেকে বার করে।
-
জলের উৎসঃ
- প্রকৃতির জলের উৎস তিন রকমের-
- ভূপৃষ্ঠস্থ,
- ভূগর্ভস্থ
- বৃষ্টির জল।
- গঙ্গানদীঃ গঙ্গা নদীগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন এই নদীতে ৩২ কোটি লি, নােংরা জল, ৬০ লক্ষ টন রাসায়নিক সার, ৯ হাজার টন কীটনাশক পড়ছে। ফলে গঙ্গা হয়ে পরছে বিষাক্ত।
জলবাহিত রােগঃ জলে মিশ্রিত বিভিন্ন রােগ জীবাণু বা রাসায়নিক পদার্থ পান করলে জলবাহিত রােগ হয়। -
জলবাহিত রােগ জীবাণুঃ
- ই. কোলাই,
- সালমােনেলা টাইফি ও প্যারাটাইফি,
- শিগেলা,
- ভিব্রিও কলেরি,
- এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা,
- জিয়ারডিয়া,
- পােলিওমাইলেটিস,
- হেপাটাইটিস এ,বি,সি,ডি ও ই,
- গিনি ওয়ার্ম,
- বিভিন্ন ভাইরাস এবং প্রােটোজোয়া।
- জলবাহিত জীবাণু ঘটিত রােগঃ
- ডায়ারিয়া, টাইফয়েড, প্যারা টাইফয়েড, জিয়ারডিয়াসিস,
আমাশয়, জন্ডিস-এ এবং ই, কলেরা, গিনি ওয়ার্ম, ডিসেন্ট্রি পােলিও মাইলেটিস।
সমাধান কোন পথেঃ জনগণকে দূষণমুক্ত নিরাপদ জল পৌঁছে দিতে পারলেই জলবাহিত রােগের মােকাবিলা করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জলবাহিত রােগ প্রতিরােধের
বিষয়ে বলেছেন – যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ জল সবসময়ের জন্য বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়া প্রয়ােজন।
আর্থিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৫ বছরে জলবাহিত রােগ যতটা আর্থিক ক্ষতি করে সেই টাকায়
সকলের জন্য নিরাপদ জল পৌঁছে দেওয়া যায়। -
পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ
পশ্চিমবঙ্গের ১০ টি জেলার ৭৯টি ব্লকের ৫৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ আর্সেনিক জনিত রােগে আক্রান্ত।
৫৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ আর্সেনিক যুক্ত জল নিয়মিত পান
করে চলেছেন।
সমীক্ষার কাজ যতই এগিয়ে চলেছে ততই সমস্যাটির গভীরতা
আরাে ব্যাপকভাবে বােঝা যাচ্ছে।
আর্সেনিক কিঃ
আর্সেনিক-এর ইলেকট্রন বিন্যাসঃ 1S2/2S2p6/3Sp63d/4S²4p পর্যায়ে সারণীর ৪র্থ পর্যায়ে এবং ৫ম শেণীতে (VB) অন্তর্ভুক্ত একটি মৌল।ধাতু এবং অধাতু উভয়ের ধর্ম-এর মধ্যে বর্তমান। একে ধাতুকল্পে বলা হয়।পারমাণবিক সংখ্যা-৩৩, পাঃ গুরুত্ব-৭৪,৯২, প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না।
খনিজ হিসেবে যেমন- নিকেলাইন (NIAs), কোবালটাইট (CoAsS),
অলটাইট (CoAs., এরিথ্রাইট Co(AsO),8H2O আর্সেনাে পাইরাইট,আর্সেনেট, আর্সেনাইট প্রভৃতি।
আর্সেনিক দূষণের উৎসঃ
আর্সেনিক দূষণের সমস্যাটি মূলত প্রাকৃতিক। আরাে বিশেষভাবে বলা যায় ভূতাত্ত্বিক। বিজ্ঞানীরা আর্সেনিক দূষণের উৎস হিসেবে যে কারণগুলির কথা বলেছেন সেগুলি হলঃ
(১) ভূতাত্ত্বিকঃ ভূগর্ভস্থ জলকে অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত পরিমাণে পানীয় জল ,জল সেচের জন্য তুলে আনাটাই আমাদের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূগর্ভের আর্সেনিক ঘটিত খনিজগুলিতে অক্সিজেনের সংযােগ ঘটে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, ফলে আর্সেনিক জলে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে।
বর্ষাকালে ভূগর্ভস্থ জলস্তর বেড়ে গেলে ধাতব আর্সেনেট এবং আর্সেনাইট যৌথগুলি জারিত হয়ে জলের মধ্যে মিশে যায় এবং এভাবেই পানীয় জলে আর্সেনিক সমস্যাটি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে(FeS,+2H,O+702 >2Fe+2+4HSO4)।
(২) কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারঃ কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাধ্যমে ভূগর্ভে আর্সেনিক প্রবেশ করে ভূতাত্ত্বিক উপায়ে জারিত হয়ে আর্সেনিক দূষণ ঘটাতে পারে। যেমন ফসফেট সার বেশি পরিমাণে ব্যবহারে মাটিতে (ভূগর্ভে) আর্সেনেট স্খলিত হয়ে ভূগর্ভের জলে মিশে যায়।
৩) রাসায়নিক শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থঃ যেসব শিল্প কারখানায়(যেমন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওষুধ কারখানা, রঙ ও কীটনাশক উৎপাদন কেন্দ্র)আর্সেনিক যৌগ বা ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেসব শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থ থেকে আর্সেনিক দূষণ ঘটতে পারে। নির্দিষ্ট ভাবে শিম্পাঞ্চলেই এই দূষণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
প্রাথমিক লক্ষণঃ কালাে বা বাদামী দাগ সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকে, চামড়া (হাত পা) পুরু বা খসখসে হয়, গুটি দেখা যায়। শারীরিক দুর্বলতা, পেটের বিভিন্ন উপসর্গ,লিভারের অসুখ, হাত পা ঝিঝিন, অবশভাব, ফুলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়।কাশি, হাঁপানি, যকৃতে স্ফীতি , প্লীহা স্ফীতি, উদারী, রক্তাল্পতা, পেশী প্রদাহ, পেশীর ক্ষীণতা, হাতে বা পায়ের তলায় ছােট-ছােট মাংসপিন্ড বা কেরাটোসিস, শ্বাসকষ্ট,সিরােসিস বা ক্যান্সার (ত্বক, লিভার, ফুসফুস ও কিডনি) হতে পারে।
- কি ভাবে বাঁচবেন
- ক) যদি আর্সেনিক প্রবণ এলাকা হয়, তবে প্রথমেই
জল পরীক্ষা করান। সর্বদা আর্সেনিক মুক্ত জলপান করুন। - খ) প্রয়ােজনে নদী,পুকুর, খাল, কুয়াের জল পরিশুদ্ধ করে খাওয়া যেতে পারে।
- গ) আর্সেনিক যুক্ত জলহলে ফটকিরি বা অ্যালাম মিশিয়ে ৫-৬ ঘন্টা রেখে পরিশ্রত করলে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ আর্সেনিক দূর করা যেতে পারে।
- ঘ) দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে বলা যায় ভূপৃষ্ঠস্থ জলসম্পদকে (খাল, বিল, নদী, পুকুর) বা বৃষ্টির জলকে ধরে রেখে ব্যবহার করা প্রয়ােজন। নদী বা জলাশয়ের গভীরতা বৃদ্ধি, পলি দূরীকরণ, মজা নদী পুনরুদ্ধার, বৃক্ষরােপণ, ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণগত ও গুণগত মান বজায়
রাখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। - আর্সেনিক কেন এত বিপজ্জনকঃ
- (১) কোষের মাইটোকনড্রিয়ায় অক্সিডেটিভ ফসফেট অন্তর্ভুক্তিকে আর্সেনিক বাধা দেয়। ফসফেটকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিভিন্ন এনজাইমের ক্রিয়াকেও নষ্ট করে দেয়।
- ফলে কোষের পুষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে কোষে আর্সেনিক জমতে থাকলে কোষের স্বাভাবিক কাজ
ব্যাহত হয়। - (২) আর্সেনিক জলের মাধ্যমে সারা শরীরে ঢুকে প্রথমেই যকৃৎকে
আক্রমণ করে। - (৩) যকৃৎ থেকে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে শরীরের বিভিন্ন অংশে কালাে ছিট, রুক্ষ ত্বক, গুটিদানা দেখা যায়, একে মেলানােসিস বলে। নখ, চুল ও ত্বকের খােসা পরীক্ষা করে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা যায়।
- (৪)শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দেয় যেমন কাশি, হাঁপানি, পেটের রােগ, জনডিস, যকৃৎ বা প্লীহাস্ফীতি, পেশী ক্ষীণ, ত্বকে ঘা, হাঁটতে না পারা, হাতের বা পায়ের তলা / তালু ফেটে যাওয়া (একে কেরাটোসি বা ক্যানসার বলে)। দীর্ঘদিন ধরে রােগে ভুগে মৃত্যু হয়।
আর্সেনিক দূরীকরণের চারটি সহজ পদ্ধতিঃ পানীয় জলে আর্সেনিক দূর।
করার জন্য যে চারটি পদ্ধতির কথা জানা গেছে সেগুলির মূল সরঞ্জাম গুলি হল-
(১) আর্সেনিক জল ধারণের জন্য ঢাকনা দেওয়া একটি বালতি বা পাত্র (১৫-২৫
লিটার জল যাতে ধরে) (২) ২-৮ টি ক্যান্ডেল (সাধারণ ফিল্টার যা বাজারে পাওয়া
যায়)। (৩) একটি জল সংগ্রাহক পাত্র। (৪) জল নাড়ার জন্য একটি বাঁশের দেড়
ফুট লম্বা, আধ ইঞ্চি ব্যাসের লাঠি। (৫) তলানি রাখার জন্য একটি পুরােনাে পাত্র। - জলাভূমি সংরক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা
জলাভূমি সংরক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা কতখানি ও
১) জলাভূমি থেকে প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি পাওয়া যায়।
২) তাজা খাদ্য, শাক-সবজির মােট উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ জলাভূমি থেকে পাওয়া যায়।
৩) জলাশয় থেকে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন পাওয়া যায়। একটি জলাভূমিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন পাওয়া যায়, তা ওই জলাভূমির দুগুণ বড় আয়তনের জঙ্গলে উৎপন্ন অক্সিজেনের সমান।
৪) শহরে বায়ু দূষণের ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনাে-অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইডের মতাে যেসব বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়, সেগুলির বেশির ভাগই জলাশয়গুলি টেনে নেয়। ফলে বাতাস দূষণমুক্ত হয়। যে অঞ্চলে জলাভূমি বেশি সংখ্যক থাকবে সেই অঞ্চলের বাতাস ততই নির্মল ও দূষণমুক্ত থাকবে।
৫) শহর ও মফঃস্বলে দূষণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জলাভূমি না থাকলে দূষণ বাড়বে, কমবে অক্সিজেন ফলে মানুষের নানা রােগ- হাঁপানি, সর্দি-কাশি ও অন্যান্য বুকের রােগ বেড়ে যাবে।
৬) জলাভূমি ঠিকঠাকমতাে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে ঐ অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বেড়ে যাবে। ফলে বাইরে থেকে মাছ আমদানি কমবে। মাছের উৎপাদন বাড়লে ফিসমিলের উৎপাদনও বাড়বে। এই ফিসমিল খেলে হাঁস, মুরগী বেশি পরিমাণে ডিম দিতে পারবে। এছাড়াও ডিমের খােসা মাটিতে মিশলে মাটির ক্যালসিয়াম ও সফরাসের পরিমাণও বাড়বে। সামগ্রিকভাবে পুষ্টির চাহিদা অনেকটাই পূরণ হবে।
৭) জলাভূমি ঠিকমতাে সংরক্ষণ করতে পারলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে।কোনও অঞ্চলের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় থাকবে।
৮) জলাভূমি সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে খরা-বন্যা সমস্যা বহুক্ষেত্রেই সমাধান করা যায়। আঞ্চলিকভাবে যদি খাল-বিল, পুকুরগুলির গভীরতা নির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধি করা যায় তবে জলধারণ ক্ষমতা বাড়বে, পাশাপাশি ঐ জল বহুক্ষেত্রে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সম্প্রতি পঃবঙ্গের জল সম্পদ বিভাগের সচিব রাজ্যে ১০,০০০ পুকুর বা জলাভূমি সংস্কারের জন্য ৫০ কোটি টাকা ব্যায়ের এক পরিকল্পনা পেশ করেছেন। যদি এই প্রকল্পের সাহায্যে প্রকৃতপক্ষে পুকুরগুলির গভীরতা বৃদ্ধি ও
সংস্কার করানাে যায়, সেক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হবে। পাশাপাশি রাজ্যেআর্সেনিক দূষণ সমস্যাটির অনেকাংশে সমাধানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
প্লাস্টিকের বিপদ ও বিকল্প
বিপদ
আমার দেশে পুরনো প্লাস্টিকের ব্যবহার এতই বেশি (মােট প্লাস্টিক
উৎপাদনের ৩৭ শতাংশ)যে পুনব্যাহারকারি প্রক্রিয়াতে যে দৃষণ সৃষ্টি হয়, তার
চিন্তার বিষয় কারণ এই পদ্ধতিতে উৎপন্ন বিষাক্ত (ডাই-অক্সিন ও ফিউরেন প্রভৃতি)
পদার্থ শুধু কারখানার শ্রমিক নয়, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্লাস্টিকের পচনশীল ধর্ম নেই। তাই ক্রমেই প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রকৃতির আবর্জনা
বাড়িয়ে তুলেছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নালা-নর্দমা, অনুর্বর হয়ে পড়ছে চাষের জমি।
একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের প্লাস্টিকের প্রতি আকর্ষণ পরিবেশকে বিপর্যয়ের
মুখে ঠেলে দিচ্ছে অপরদিকে হাসপাতালের প্লাস্টিক আবর্জনা যেমন সিরিঞ্জ, রবার,
ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন বােতল ও অন্যান্য ব্যবহৃত প্লাস্টিক পদার্থ পরিবেশে বিভিন্ন
দুরারােগ্য রোগ ছড়াচ্ছে।
বিকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে উন্নত দেশগুলির ন্যায় ভারতে এর সমস্যা ক্রমশঃ ঘনীভূত হচ্ছে। বর্তমানে এই প্লাস্টিক দূষণ থেকে রেহাই পেতে হলে প্লাস্টিকের বিকল্প অবশ্যই খোঁজা দরকার। ক্ষেত্র বিশেষে প্লাস্টিকের বিকল্প ভিন্ন ভিন্ন বস্তু হতে পারে। যেমন প্লাস্টিকের চায়ের কাপের পরিবর্তে চিনা মাটির ভাড় অপেক্ষাকৃতনিরাপদ।
প্রয়ােজনে অপ্রয়ােজনে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের পরিবর্তে চট বা কাপড়ের টেকসই
থলে ব্যবহার করা যেতে পারে। সমগ্র বিশ্বে প্লাস্টিকের ক্যারিবেগের ব্যবহার ছেয়ে গেছে অথচ আমরা জেনেছি, এই ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করা কতটা অপকারী ।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, প্রধাণতঃ কৃষি নির্ভরশীল দেশ। ভারতে প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের পরিবর্তে যদি পাটের ছােট-বড় সুন্দর থলে বা ব্যাগ ব্যবহার করা হয় তবে আমাদের দেশ এই দুষণ থেকে মুক্ত হবে অপর দিকে আমাদের দেশীয় কৃষিব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাব আছে।
প্লাস্টিক দূষণমুক্ত পৃথিবীর জন্য প্রয়ােজন এক সঠিক জীবন দর্শন। আমরা ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলব এই মানসিকতার পরিবর্তে ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারের মনােভাব নিয়ে সযত্নে জিনিসের ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃতির ভান্ডার আমাদের প্রয়ােজন মেটাতে যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের লােভ মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। আমাদের উন্নয়নের ধারণা প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে করলে চলবে না, গড়ে তুলতে হবে এক জীবনমুখী পরিকল্পনা।
মৃত্তিকা দূষণ
ভূপৃষ্ঠকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার ফলে ভূপৃষ্ঠ দূষিত হয়ে পড়ছে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ বসবাসের অনুপযােগী হয়ে উঠছে কারণ ঃ-
ক) বিভিন্ন রকম রাসায়নিকের ব্যবহার ঃ আমরা চাষের সময় যে কীটনাশক ব্যবহার করি তা মাটির সাথে মিশছে। এই কীটনাশক মাটিতে অবস্থিত উপকারী কীটগুলিকে ধ্বংস করে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। আবার বিভিন্ন রকম রাসায়নিক । কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা ধ্বংস করছে। যেমন- আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্রতি বছর ১কোটি তড়িৎ কোষ (ব্যাটারী)ব্যবহার এর পর যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই তড়িৎ কোষে অবস্থিত তীব্র অ্যাসিড মাটির উর্বরতা ও গুণমানকে পরিবর্তন করে চাষের অনুপযােগী করছে।
খ) খনিজ পদার্থের বিপুল উত্তোলনঃ কয়লা, লােহা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি
খনি থেকে প্রচুর পরিমাণে ঐ সকল পদার্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু ভিতরের
ফাঁকা স্থান আমরা ঠিক ভাবে ভরাট করছি না তাই ঐ স্থানে ধস নেমে বাসের ও
চাষের অনুপযােগী স্থানে পরিণত হচ্ছে।
গ) যত্রতত্র তাপ বিদটুতের ছাই ফেলাঃ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই যেখানে
সেখানে ফেলে আমরা ঐ স্থান চাষের অনুপযােগী করে তুলছি।
ঘ) বৃক্ষ ছেদনঃ
পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত বড় বড় গাছ মাটিতে শক্ত ভাবে ধরে রাখে এবং পাহাড়কে ধসের হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু পাহাড়ে অবস্থিত গাছ অনিয়মিত কাটার ফলে পাহাড়ে ব্যাপক ধস নেমে এসে বাস ও চাষের অনুপযােগী হয়ে চলেছে।
ঙ) ইট ভাঁটায় ব্যবহৃত মাটিঃ
বিভিন্ন ইট ভাটায় চাষের জমির মাটি ইট তৈরির কাজে ব্যবহৃত করছে। চাষের জমির মাটির প্রথম ১-২ ফুট অত্যন্ত উর্বর। এই মাটি ইট তৈরীর কাজে ব্যবহার এর ফলে প্রচুর চাষের জমি অনুর্বর জমিতে পরিণত হচ্ছে। যদিও চাষের জমির মাটি ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করা আইনত অপরাধ।
মৃত্তিকা দূষণ রােধে যা যা করা দরকার ঃ
১) রাসায়নিক সার ও কীটনাশকএর ব্যবহার কমাতে হবে।
২)প্লাস্তিক জাতীয় পদার্থ যাতে মাটিতে না মেশে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
৩)চাষের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করে চাষের পরিবর্তন করা দরকার।
৪)মাটির তলার জল চাষের কাজে ব্যাবহার করা আনুচিত।
৫)শিল্প কারখানা ও শহরের অজৈব পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
৬)মাটিতে সর্বদা জৈব সার ব্যাবহার করতে হবে।
খরা বন্যা সমস্যা
আমাদের রাজ্যে তথা সারা ভারতবর্ষেই খরা-বন্যা সমস্যাটি লেগেই রয়েছে।
বৃষ্টির জল ধারণ করার মত ভূপৃষ্ঠস্থ জলাশয়ের সংখ্যা খুবই কম এবং এই জলাশয়গুলির সংখ্যাও ক্রমশঃ হ্রাসমান। তাছাড়া এই জলাশয় গুলির গভীরতাও খুবই কম, যার ফলে বৃষ্টিপাত হলে জল ধারণ করতে পারে না। তাই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে বন্যা অনিবার্য, আবার বৃষ্টিপাত না হলেই খরা।
খরা-বন্যা সমস্যা মােকাবিলায় বিকল্প সমাধানগুলি হল
১) খাল, বিল, নদী,জলাশয়গুলির গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২) সেচ ব্যবস্থা ও ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য আঞ্চলিক স্তরে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩)বৃষ্টির জলকে ভূপৃষ্ঠ জলাশয়ে ধরে রাখার জন্য সঠিকভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
৪)। নদীর পাড় সংরক্ষণ, মজা নদীকে সংরক্ষণ করতে হবে।
৫) যত্রতত্র গভীর নলকূপ বসানাে বন্ধ করতে হবে।
৬) ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার সীমিত ভাবে করতে হবে এবং বৃষ্টির জল যাতে ভূগর্ভে মিশতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বায়ু দূষণ
বায়ুদূষণের কারণ ঃ ১) কলকারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকারক গ্যাস। ২) যানবাহন
থেকে নির্গত গ্যাস। ৩) তেজস্ক্রিয় দূষণ।
বায়ুদূষণের ফল ঃ
১) পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
২) ওজন স্তরের ছিদ্র।
৩) পরিবেশে অল্প বৃষ্টি ও অম্ল বৃষ্টি।
কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকারক গ্যাস ঃশিল্প বিপ্লবের পর থেকেই সারা পৃথিবীতে বায়ু দূষণ পেয়েছে। প্রতিটি কারখানা থেকেই নির্গত গ্যাসগুলি পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক
যেমন- ক) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাই, কালাে ধোঁয়া পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছাই নিরােধক যন্ত্র বসালে কালাে ছাই রােধ করা যায়, পাশাপাশি মেকানিক্যাল ডাস্ট কালেকটর এবং কুলিং সিস্টেম থাকলে পরিবেশের দূষণ কমানাে যায়। প্রতিটি শিল্পকারখানায় এই ব্যবস্থা নেন না,
ফলে দূষণ বেড়েই চলে। প্রতিটি শিল্প কারখানার ক্ষেত্রেই দূষণ প্রতিরােধক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরী।
বায়ু দূষক ঃ
পৃথিবীর বায়ু দূষণের ৯০ শতাংশের জন্য দায়ী হল-
১) কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2),
২)কার্বন মনােক্সাইড (CO),
৩) নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড (N2 O, NO2, N2 O5, N2O4),
৪) হাইড্রোকার্বন
৫) সালফার অক্সাইড (SO2)
৬) ধূলি কণা।
ওজোন স্তরের ক্ষয়
ওজোন স্তর যেন পৃথিবীর বেশ বড় একটা ছাতা। কিন্তু এই ছাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওজোনের পরিমাণ কিছু অঞ্চলে কমে গেছে। ফলে অতি সহজেই এই অঞ্চল দিয়ে ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছে যাচ্ছে।
কেন ওজোন কমে যাচ্ছে ওজোন স্তর ক্ষতির জন্য দায়ী ক্লোরিন পরমাণু আর এই ক্লোরিন পরমাণুর উৎস হিসাবে কাজ করছে ক্লোরােফ্লুরােকার্বন (CFC) নামে একটি যৌগ। এই ক্লোরােফ্লুরােকার্বন প্রায় ৭০ বছর আগে ব্যবহারিক জীবনে প্রথম প্রয়োগ করা হয়। এই যৌগটি রেফ্রিজারেটরে, ফোমপ্যাকেজিং-এ, যানবাহন শিম্পে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রে প্রচুর ব্যবহার হতে লাগলাে। ফলে বায়ুমন্ডলে এর পরিমাণও বাড়তে থাকলাে।
দেখা গেছে একটি ক্লোরােফ্লুরােকার্বন (CFC) অণু বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তরের একলক্ষ ওজোন অণুকে (03) বিভক্ত করে। এই সি, এফ, সি, যৌগ ওজোন অণুকে ধ্বংস করার পাশাপাশি ওজোন অণু তৈরির পদ্ধতিতেও বাধা দেয়।
এইভাবে ওজোন স্তরের ক্ষয়ের পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্তমানে সমস্ত ওজোন স্তরে গড়ে ৮ শতাংশ ওজোন কমে গেছে। কিভাবে এই ধংস আটকানাে যায়, ক্ষয়ের পরিমাণদ্রুত বাড়তে থাকে।
বর্তমানে সমস্ত ওজোন স্তরে গড়ে ৮ শতাংশ ওজোন কমে গেছে। কিভাবে এই ধ্বংস আটকানাে যায়, ক্ষয়ের পরিমাণ কমানাে যায় তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে।
অম্ল বৃষ্টি (Acid Rain)
আম্লিক জলের বৃষ্টিকে (pH < 5) সাধারণভাবে অম্ল বৃষ্টি বলে। এর ফল মাটি ও জলাশয়ের জীবের জীবনধারণের পরিবেশ নষ্ট হয়। গাছ-পালা, মাটির প্রভূত ক্ষতি হয়। তাছাড়া বাড়ী-ঘর, ধাতুনির্মিত সেতু, পুরাতন ভাস্কর্য, স্থাপত্য (তাজমহল, ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়াল) ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ধরনের বৃষ্টির কারণ কলকারখানার চুল্লী এবং মােটর গাড়ী থেকে নির্গত সালফার, নাইট্রোজেন ও কার্বনের অক্সাইড সমূহ যা বাতাসের জলকণার সাথে মিশে বিভিন্ন অ্যাসিড উৎপন্ন করে।এই অ্যাসিড বৃষ্টির সঙ্গে বর্ষিত হয়ে থাকে।
তেজস্ক্রিয় দূষণ
পৃথিবীতে যেসব প্রাকৃতিক মৌলিক পদার্থ আছে তাদের মধ্যে শেষের দিকে রেডন, রেডিয়াম, পােলিনিয়াম, থেরিয়াম ও ইউরেনিয়াম প্রভৃতি মৌলগুলি সর্বদাই শক্তি (তেজ) বিকিরণ করে এবং ক্রমশঃ ভর হারাতে হারাতে নিমতরের স্থায়ী মৌলতে পরিণত হয়।
পরমাণু মূলতঃ তিন ধরনের কণিকা (ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন) নিয়ে গঠিত।আলফা, বিটা ও গামা বিকিরণগুলির যেকোন জীবের পক্ষে ক্ষতিকর। জীবকোষ বিভিন্ন যৌগদ্বারা গঠিত, আবার যৌগে রয়েছে জীবকোষ কোন তেজস্ক্রিয় রশি পড়লেই এইসব বিভিন্ন পরমাণু মৌলিক আয়নিত পদার্থের হয় এবং পরমাণু কোষের।
স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে কোষের স্থায়ী পরিবর্তণ হওয়ার কারণে ক্যানসার, লিউকোমিয়া হতে পারে। তেজস্ক্রিয় দূষণের প্রভাব জনন কোষে পরিবর্তন ঘটলে বিকলাঙ্গ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তেজস্ক্রিয়তা (তেজস্ক্রিয় দূষণ) যেকোন মাত্রারই হােক, তা সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। পরমাণু চুল্লী (বিদ্যুৎ কেন্দ্র) থেকে পুটোনিয়াম সহ প্রায় ২০০ রকমের তেজস্ক্রিয় পদার্থ উৎপন্ন হয়। পরমাণু বােমা তৈরির মূল উপাদানই হল পুটোনিয়াম।
পরমাণু চুল্লী থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় খুবই কম, অথচ খরচও খুব বেশি এই চুল্লী পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই তেজস্ক্রিয় দূষণ না কমাতে পারলে সামগ্রিক পরিবেশ ও জীবের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
পৃথিবী জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে
১৯৭২-এর পর আরও তিনটি বসুন্ধরা বৈঠক ও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মেয়াদও শেষ হওয়ার মুখে। অথচ পরিবেশে গ্রিন হাউস গ্যাস সহ তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখকরছি ঃ
ক) প্রতিটি শিল্প কল-কারখানায় দূষণ প্রতিরােধক ব্যবস্থা ঠিকমতাে কার্যকরী করতে হবে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কয়লা (কার্বন ডাই ও কার্বন মনাে অক্সাইড) বাতাসে মিশতে না পারে সেই জন্য ইলেকট্রো স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ই.এস.পি)মেকানিক্যাল ডাস্ট কালেকটর ও কুলিং সিস্টেম পুরােপুরি কার্যকর করতে হবে।এর ফলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ সমস্যা বেশীর ভাগটাই সমাধান হবে।
খ) বছরে প্রায় ১০০ কোটির বেশী জীবাশ্ম পুড়িয়ে ২৫০ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড (Co,) বাতাসে মিশছে। ফলে দূষণের মাত্রা ভীষণ ভাবে বেড়েই চলেছে।
পঃবঙ্গে শুধুমাত্র বছরে মাত্র ৬০ হাজার মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে নিম, শাল, বট, অশ্বথ,অর্জুন, মেহগিনি, ক্যাকটাস ও সাইট্রাস, তুলাগাছ বেশী পরিমাণে নদী, জলাশয়ের পাড়ে, পতিত অঞ্চলে ও শহরের রাস্তায় লাগাতে হবে, কারণ এ ধরনের গাছ গুলি বেশী পরিমানে কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিতে পারে।
গ) সারা পৃথিবী জুড়ে ১৯৮৬ সালের পর নতুন করে পরমাণু চুল্লী স্থাপন করা হয়নি,(দু-একটি দেশ ব্যতিক্রম)। শক্তি সমস্যা সমাধানের জন্য পরমাণু চুল্লী কোন ভাবেই গ্রহণ যােগ্য নয়, অথচ প্রতিটি পরমাণু চুল্লী শুধুমাত্র পরিবেশকে বিভিন্ন ভাবে বিষাক্ত করে তুলেছে। বিকল্প শক্তির উৎস গুলিকে যথা- জল বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, হাওয়া কল ও বায়ােমাস গ্যাস সহ বিভিন্ন ধরনের পুনর্নবীকরণযােগ্য শক্তির উৎসগুলিকে কাজে লাগাতে হবে এবং পাশাপাশি এই ধরনের শক্তিগুলির ব্যবহারকে আরাে
বাড়িয়ে তােলার জন্য গবেষণায় অর্থবরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং ছােট ছােট বিদ্যুৎ প্রকল্প আঞ্চলিক স্তরে তৈরী করতে হবে। সুসংহত উপায়ে বিকল্প শক্তির উৎসগুলিকে কাজে লাগিয়ে শক্তি সমস্যা চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা যেতে
পারে।
ভারতে পুনর্নবীকরণ যােগ্য শক্তির উৎসগুলাের সম্ভাবনা নীচে উল্লেখ করা হলাে ঃ
| | পুনর্নবীকরণ যােগ্য শক্তির উৎস সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদন
১) সূর্য (Solar Energy) ৫,৭০,০০০ মেগাওয়াট
২) ছােট বড় জল বিদ্যুৎ ৭০,০০০ মেগাওয়াট
৩) হাওয়া-বায়ু চালিত বিদ্যুৎ ৩০,০০০-৬০,০০০ মেগাওয়াট।
৪) বায়ােগ্যাস বা জৈব গ্যাস ১৭,০০০-৬০,০০০ মেগাওয়াট।
৫) সমুদ্রের তাপ বিদ্যুৎ ৫০,০০০ মেগাওয়াট
৬) সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ ২০,০০০ মেগাওয়াট
৭) উন্নত চুল্লা ১২০ মিলিয়ন (সংখ্যায়)
পরিবেশ প্লাস্টিক আর্বজনা (যেমন স্যালাইন বােতল, ব্লাড ব্যাগ রবার ও অন্যান্য ব্যবহৃত প্লাস্টিক) পােড়ানাের ফলে ডাই অক্সি ও ফিউরেন নামক বিষাক্ত গ্যাসগুলি বাতাস মিশছে। ফলে তাপমাত্রা ও পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। এছাড়া যে সমস্ত শিল্পে ক্লোরােফ্লোরাে কার্বন (CFC) বেশী ব্যবহার করা হচ্ছে সেসব শিল্পে ধাপে ধাপে-এর ব্যবহার পুরােপুরি কমিয়ে আনতে হবে। যেমন যে দেশ যত বেশী পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস দূষণ করবে সেই পরিমাণে গাছ লাগিয়ে দূষণ কমিয়ে আনবে (কার্বন লিঙ্ক প্রজেক্ট)। তাছাড়া প্লাস্টিক ব্যবহার ক্রমশ কমিয়ে আনতে হবে। পরিবেশের পক্ষে উপযােগী জুট বা পাট জাতীয় ব্যাগ, চটের থলে ব্যবহারের পরিমাণ বাড়াতে।
চ) কৃষি ক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে, জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কৃষি জমিতে যাতে শিল্প কারখানার আর্বজনা, প্লাস্টিক আর্বজনা মিশতে না পারে। মাটির তলা থেকে কখনই অতিরিক্ত পরিমাণে জল তােলা উচিত নয়।
দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রয়ােগ ঘটাতে হবে ও পাশাপাশি বিদেশ থেকেঅপ্রচলিত প্রযুক্তি আমদানী বন্ধ করতে হবে। দেশের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রগুলি সাধারণ মানুষের প্রয়ােজনের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ চালাতে হবে।পরিবেশের প্রতিটি বিষয়কে সুরক্ষিত রেখেই সামগ্রিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে।
সারা বিশ্বে শক্তি সমস্যার সমাধান গুলি কোন পথে
তাপবিদ্যুৎ এর উৎস কয়লা খনি থেকে পাওয়া যায় এবং পরমাণু বিদ্যুৎ-এর
ইউরেনিয়াম (খনি থেকে পাওয়া যায়)-উৎসগুলি কোন না কোন দিন শেষ হয়েই যাবে। অথচ পুনর্নবীকরণ যােগ্য শক্তির উৎসগুলি ভবিষ্যতে কোন দিনই শেষ হবে। বিকল্প শক্তি অর্থাৎ নবীকরণ যােগ্য শক্তির উৎসগুলি যথা- বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, সৌরশক্তি, জৈবগ্যাস, সমুদ্রের তাপবিদ্যুৎ শক্তি গুলিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানাে, পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক (জীবাশ্মজ্বালানী) জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে।
সারা ভারতে মােট বিদ্যুৎ চাহিদার ২.৬ শতাংশ মাত্র পাওয়া যায় পরমাণু চুল্লী থেকে (৪১২০ মেঃওয়াট) উল্লেখ করা দরকার ভারতের রাজস্থান অ্যাটমিক পাওয়ার প্রজেক্ট ১ নং এবং ২ নং চুল্লী তৈরী করতে সময় লেগেছিল যথাক্রমে ৮ এবং ১০ বছর, চেন্নাই-এর কলাস্কমে সময় লেগেছিল আরাে বেশী যথাক্রমে ১৪ এবং ১১ বছর।
পশ্চিমবঙ্গের অচিরাচরিত শক্তি ব্যবহারের চিত্রটি ঃ
বায়ােগ্যাস প্লান্ট-১,৮৫,৪৯১ টি
বায়ােগ্যাস প্রকল্প-১.১৩ মেগাওয়াট
ধানের তুষ ভিত্তিক প্রকল্প-৪.৬৮ মেগাওয়াট
সৌরগৃহ আলােক ব্যবস্থা-৩৮,৯৪৪ টি
সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র-৫৮৫ কিলােওয়াট
বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র-১.৬ মেগাওয়াট
জলবিদ্যুৎ প্রকল্প-২৮.৫ মেগাওয়াট
উন্নত চুলা – ৩,৬৯,৭৮৭ টি
অচিরাচরিত শক্তি বা বিকল্প শক্তি
১) ৫০শতাংশ বিদ্যুৎ পুর্নব্যবহার পাওয়া যেতে পারে ।
২) ওয়েবরেডা ফেজার গঞ্জে ও সাগর দ্বীপে ২.৫ মেঃ ওয়াট (হাওয়া কল থেকে) বায়ু বিদ্যুৎ তৈরী করছে। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে ৬০ মেঃ ওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য জায়গায় সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
৩) জোয়ার ভাটা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুন্দরবনে ৩.৭৫ মেঃ ওয়াট বিদ্যুৎ তৈরী করার কাজ চলছে। এই অঞ্চলে হাওয়া বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে ছােট ছােট
বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে।
৪) উত্তরবঙ্গে বায়ােমাস থেকে ১৫০ মেঃ ওয়াট বিদ্যুৎ তৈরী করার জন্য ১০০০ কোটি টাকা লগ্নি করা হয়েছে।
৫) আসানসােলে ২ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী হচ্ছে। গ্রিড সিস্টেমের সাহায্যে যাতে সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
৬) পুরুলিয়ার অযােধা পাহাড়ে ৯০০ মেঃওয়াট পাম্প স্টোরেজ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ২০০৭ সালেই চালু হয়েছে।
বার্ষিক যােজনা ও পরিকল্পনা খাতে নবীকরণযােগ্য শক্তির উৎস দপ্তরের জন্য ব্যয় বরাদ্দ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াতে হবে। উৎসগুলির সম্ভাবনা যাতে আরাে বাড়ানাে যায় সেই জন্য গবেষণা ও সমীক্ষার (বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌরশক্তি ম্যাপ) জন্য ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানাে প্রয়ােজন। সমস্ত রকমের বিকল্প ও নবীকরণ যােগ্য শক্তির উৎসগুলিকে পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যৎ-এর শক্তি সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।
জয়দেব দে, বিজ্ঞান কর্মী।
পানকৌড়ি কথা ও কাহিনী
পানকৌড়ি কথা ও কাহিনী: মনে পরে সেই সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের লেখা মাঝি মল্লাদের কবিতার লাইনটি “চুপ চুপ ওই ডুব দেয় পানকৌড়ি”,সেই পানকৌড়িদের নিয়েই আজ কথাবার্তা হবে l কবি যাদের সাথে ঘোমটা পড়া বউ-দের তুলনা করেছিলেন l গ্রামেগঞ্জে জলাশয় তে এদের নিয়মিত দেখা মেলে এখনো জানি না আর কত দিন,এই সোনার দিন থাকবে?যাক যতদিন থাকে ততই মঙ্গল কারণ পুকুরের বাস্তুতন্ত্রের এ এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য l
পানকৌড়ি হলো Phalacrocoracidae (ফ্যালাক্রোকোরাসিডি) গোত্রের Phalacrocorax (ফ্যালাক্রোকোরাক্স) গণের অন্তর্ভুক্ত একদল জলচর পাখি। পানকৌড়ির, বৈজ্ঞানিক নাম Phalacrocorax niger. ইংরেজিতে এরা কর্মোরেন্ট ও শ্যাগ নামে পরিচিত। পানকৌড়ির শ্রেণীবিন্যাসে বর্গ, গোত্র ও গণ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে এবং সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নতুন গণের নামও প্রস্তাব করা হয়েছে।হয়তো জীববিদ্যায় নতুন ভাবে নতুন আঙ্গিকে উঠে আসবে, পানকৌড়ি !
পৃথিবীতে প্রায় 40টি প্রজাতির পানকৌড়ি রয়েছে এবং এদের সবার দেহেরই বর্ণ কালো কিন্তু তার গাঢ়ত্বের তারতম্য রয়েছে। পানকৌড়ি খুব ভাল সাঁতারু ও এদের খাদ্য হলো প্রধানত মাছ, এই কারণে খাদ্যের খোঁজে এরা জলের গভীরে ডুব দিতে সক্ষম lপানকৌড়ি জলে নেমে মাছেদের স্বর্গরাজ্যে গিয়ে ধাওয়া দিয়ে শিকার ধরে, ভাাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকে না। তার শিকার ধরার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট কোনো কৌশল দেখা যায় না, বরং তার চেয়ে দৈহিক তৎপরতা এবং শ্রমই অনেক গুন বেশি।
দুই বাংলায় পানকৌড়ি অতি পরিচিত পাখি, বিশেষ করে খাল বিল যুক্ত অঞ্চলে। এরা উচ্চতায় প্রায় 50-55 সেন্টিমিটারের হয়ে থাকে । সারা দেহই, কুচকুচে কালো, তাতে সামান্য উজ্জ্বল চকচকে আভা দেখা যায় । গলায় সাদা একটি দাগ, পাখার নিচের পালক ধূসর রংয়ের। লেজের আকৃতি অনেকটা নৌকার বৈঠার মতো। ঠোঁট সরু, কিছুটা বাঁকানো ধরনের, ঠোঁটের অগ্রভাগ বড়শির মতো বাঁকানো। যা মাছ শিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, পা দুটি ছোটো এব দৃঢ় হয়ে থাকে। হাঁসের পায়ের মতো অর্থাৎ লিপ্তপদের মতো এদের পায়ের পাতা জোড়া লাগানো থাকে । জলের মধ্যে গমনের সময় নৌকার দাঁড়ের মতো পা দিয়ে জল ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যায়।এদের চোখ-এর বর্ণ সবুজাভ বাদামি।এদের যৌন দ্বিরূপতা দেখা যায় না অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষ প্রাণী দুটি দেখতে একই রকম হয় ফলে সাধারণত আমরা এদের পার্থক্য করতে পারি না। এদের জুভিনাইল অবস্থায় নাকের ফুটো অর্থাৎ বহিঃনাসারন্ধ্র থাকে কিন্তু বয়স্কদের বাইরের দিকে নাকের ফুটা থাকে না।
ডিম পাড়ার সময় এদের গলার দাগটি মিলিয়ে যায়।যা এদের যৌবন বা যৌন পরিণতির নিদর্শন,ডিম পাড়ার সময় এদের দেহে কয়েকটি সাদা পালক দেখা দেয়; আর গলার দুপাশে কয়েকটি মিহি সাদা কোমল পালক,দেখা যায় । বাদামি রংয়ের ঠোঁট এই প্রজননের সময় লাল হয়ে ওঠে। বিবাহ অনুষ্ঠানে সাজসজ্জা ও অলঙ্করণ কেবল মানুষেরই রীতি নয়, পশুপাখির এই বৃহদ জগতেও এটি একটি সহজাত প্রাকৃতিক নিয়ম।
পানকৌড়ি সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল, হ্রদ ও নদীনালায় বসবাস করে। ডালপালা, সামুদ্রিক আগাছা ও ঝোপঝাড়, বৃক্ষ কিংবা সমুদ্রতীরবর্তী পাহাড়ের খাঁজে এরা বসবাস করে। নতুন ডিমের বর্ণ নীলচে, তবে সময়ের সাথে সাথে চকচকে সাদা বর্ণ ধারণ করে যা বলেদেয় ডিম পরিণত হচ্ছে এবং ডিম ফোটার সময় আগত। তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। তিন বছর বয়সে এরা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়। পানকৌড়ি একবারে তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো লম্বা ধরনের। একদিক সরু হয়ে থাকে। সবুজ আভাযুক্ত নীল, খোসা বেশ শক্ত। প্রথম দিকে ডিমগুলোতে চকের মতো সাদা এবং নীলাভ সাদা গুড়া মাখানো থাকে। ডিম ফোটার আগ দিয়ে হলদে ও বাদামি রংয়ের হয়ে পড়ে।
পানকৌড়ি উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের পাখি ফলে অনুকূল পরিবেশ হওয়ায় দুই বাংলার প্রায় সর্বত্রই এদের দেখা যায়। এখানকার জলবায়ু, নদী, খালবিল এদের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র। সমুদ্রের তীরে এদের দেখা গেলেও পানকৌড়ি কিন্তু সম্পূর্ণ মিষ্টি জলের জলাশয়ের পাখি। বড় পুকুর ও বিল অঞ্চলই এরা বেশি পছন্দ করে। সুন্দরবন অঞ্চলের জোয়ারের জলে পুষ্ট নদীগুলো এদের খুবই প্রিয়। হাঁসের মতো এরাও জলের সাঁতার কাটে। তবে পানকৌড়ি, সাঁতরানোর সময় তাদের শরীর জলের নিচে ডুবে থাকে, কেবল গলা ও মুখটি থাকে জলের উপর। আবার অনেক সময় ডুব দিয়েই থাকে থেকে থেকে মাথা তোলে আবার ডুব দেয়, মাছের সন্ধানে এরা জলের অনেক নীচে পর্যন্ত চলে যায়। ডুবসাঁতারেও এরা পারদর্শী। অনেক সময় একসঙ্গে অনেক পানকৌড়ি দল বেঁধে একই দিকে ডুব দিয়ে দিয়ে চলতে থাকে।
পানকৌড়ির প্রধান খাদ্য ছোট মাছ,এছাড়াও কাঁকড়া, ব্যাঙাচি, ব্যাঙ ইত্যাদিও খায়। সাঁতার কাটার সময় কোনো বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলে শুধু মাথা এবং গলাটুকু জলের উপর বের করে রেখে ডুবে থাকতে পারে। জল থেকে ওঠার সময় এদের একটু বেগ পেতে হয়। এরা জল থেকে উঠে ডাঙাতে কিংবা শক্ত কোনো জিনিসের উপর বসে পাখা শুকায়। জলের উপর কোনো ডালপালা থাকলে সেখানেও এরা সোজা হয়ে বসে পড়ে। তখন রোদে পাখা মেলে বহুক্ষণ ধরে একইভাবে বসে থাকে।
পানকৌড়ি প্রধানত বাসা তৈরি করে জলাশয় তীরবর্তী যেকোনো গাছের উপর। ঝিল বা পুকুরের ধারে কিংবা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, এমন গাছও এরা পছন্দ করে। ছোট ছোট কাঠকুটো দিয়ে বাসা বানায়। পানকৌড়ির শরীরের গঠনের তুলনায় বাসা অনেক ছোট।ভালো বাসা তৈরিতে এরা দক্ষ নয়। কাক বা বকের বানানো পুরোনো বাসা পেলেই তা দিয়েই এরা বাসস্থানের প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়। একই গাছে কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে বাস করে কারণ এরা সামাজিক পাখি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এরা শুধু নিজেরাই দল বেঁধে থাকে না, অন্য প্রজাতির পাখি যেমন বক,নিশিবক, শামুকখোল ইত্যাদি পাখির সঙ্গে একই গাছে বাসা বেঁধে একসঙ্গে থাকে।
পানকৌড়ির মল থেকে উৎপন্ন সার গুয়ানো একটি বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে যথেষ্ট সমাদৃত এবং পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এখন ব্যবহার করার জন্য l চীন ও জাপান-এর মানুষেরা মাছ ধরার জন্য বিশেষত পানকৌড়ি পোষে। সুন্দরবনেও বহু জেলে এখন এই পদ্ধতিতে মাছ ধরে থাকেন l পানকৌড়িদের গলায় একটা ধাতব গোলাকার চাকতির মতো কিছু পরিয়ে তাতে লম্বা শক্ত সুতা বেঁধে জলে নামিয়ে দেয়। ডুব দিয়ে মাছ ধরে যখন জলে উপর ভেসে ওঠে তখন সুতো টেনে পাখির মুখ থেকে মাছ খুলে নেওয়া হয় । গলায় ওই জিনিস পড়ানো থাকে বলে পানকৌড়ি মাছ ধরেই গিলে ফেলতে পারে না। কিছুদিন এমন অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর গলায় কিছু পরানোর দরকার হয় না; তখন নিজে থেকেই মাছ এনে প্রতিপালকের কাছে দেয়।অর্থাৎ এরা যে পোষ মানে,সেটা এই ঘটনা থেকেই প্রমাণিত এবং এরা আমাদের উপকারী প্রাণী কারণ কোনো রকম ক্ষতি করে না l এরা অতিখাদক না অল্প কিছু মাছ খেয়েই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায় পেট ভরলেই l কিন্তু ভেরী বা জলাশয় তে জাল দিয়ে একাকার করে আমরাই এদের ঠেলে দিচ্ছি বিপদের মুখে আর তাছাড়া এদের মাংস খাওয়ার একটা রেওয়াজ রয়েছে l তাও আমাদের সবুজ গ্রাম বাংলার স্মৃতির সাথে জড়িত এরা,সূর্যাস্তের সময় জলের মধ্যে এদের ডুব দেওয়ার দৃশ্য আমাদের নস্টালজিয়াকে জাগিয়ে দেয় l সেই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য যেন না হারিয়ে যায়,এটাই অনুরোধ সকলের কাছে l
সৌভিক রায়
মহা প্রলয়ের পর
বুধবার, ২০শে মে ২০২০র দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা ১১০ -১৩০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতির বয়ে যাওয়া ঝড়ো বাতাসের পর দক্ষিণ বঙ্গের ছয়টি জেলার বিস্তির্ণ অংশে যে লন্ডভন্ড কান্ড ঘটেছে তাকে মহা প্রলয় ছাড়া অন্য কোন ভাবে বাখ্যা করা যায়না। এই অতি প্রবল ক্রান্তীয় ঘুর্ণিঝড়ের সাথে অনেকে ২০০৯ সালের ঘুর্ণিঝড় আয়লার তুলনা করছেন বটে তবে তা অসম তুলনা। আয়লা ছিল অনেক কম তীব্রতার। তুলনা যদি করতেই হয় তবে সেটা ১৮৬৪ সালের ৫ই অক্টোবরের ঝড়ের সাথে তুলনা করাই সমিচীন হবে। সেদিন ঝড় দক্ষিণ বঙ্গের মেদিনীপুর দিয়ে উপকূল অতিক্রম করেছিল। তারপর দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার উপর দিয়ে কলকাতা হাওড়া হুগলী বর্ধমান নদিয়া হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের উপর গিয়ে দুর্বল হয়েছিল ২০শে মে ২০২০ তারিখের ঝড়ের মত। সেই ঝড়ের একটি অনুপুঙ্খ বর্ণনা বাংলার গভর্নর পাঠিয়ে ছিলেন ইংল্যান্ডের রাণীর কাছে। প্রায় ৪০০ পাতার সেই রিপোর্টের একটা পি ডি এফ কপি আছে আমার সংগ্রহে। ১৫৬ বছর আগের সেই ঝড়ে মারা গেছেন ৮০হাজার মানুষ। তার পর থেকে তদানীন্তন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ৭০টির বেশি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণশালাকে একত্রে নিয়ে এসে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারই ফলশ্রুতি ১৮৭৫ সালে স্থাপিত India Meteorolgical Department বা ভারত মৌসম বিজ্ঞান বিভাগ যার প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতায়। পরে তা নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমান আলিপুর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণশালা ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগানবাড়ি। এক সময় এই বাড়িটিকে ঘিরে কিছু উপকথা প্রচলিত ছিল যেমন গভীর রাতে বাইজিদের নুপুরের শব্দ শোনা যায়। অশরীরী চলাফেরার কথাও বলতেন কেউ কেউ। বাড়ির নীচে একটি কুঠুরি আছে। আগে সেখানে ভূকম্পন মাপার যন্ত্র বসানো ছিল। সেই কুঠুরি নিয়েও নানা গল্প প্রচলিত আছে। এখনও নিস্তব্ধ চাঁদনী রাতে সাদা রঙের অবজারভেটরি বিল্ডিং বড় রহস্যময় মনে হয়। চাকরিতে থাকার সময় শীতের মাঝরাতে জ্যোৎস্না বিধৌত সাদা রঙের বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার ইংরেজ নরনারীর মদের নেশায় মশগুল বিচিত্র সংলাপ, পিয়ানোর সুরে বল নাচ কিংবা গোপন প্রেমের চোরা চাহনি মনে মনে অনুভব করেছি। গোপন প্রেমের ফলশ্রুতি দুই ইংরেজ প্রেমিকের ডুয়েল লড়াই এই বাড়িটির সমনের রাস্তায় হয়েছিল। তাই আজও আলিপুর আবহাওয়া অফিসের ঠিকানা ৪(4)নং ডুয়েল এভিনিউ যদিও মূল রাস্তা বা এভিনিউটির
অস্তিত্ব এখন আর নেই।
আমার এই এক দোষ কোন কথা দিয়ে শুরু করে কোথায় চলে যাই। শুরু করেছি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী অবস্থা নিয়ে কিছু বলব বলে। ঝড়ের পর ছয় ছটি দিন কেটে গেছে এখনও সব জায়গায় পানীয় জল ও বিদ্যুৎ পরিসেবা চালু হয় নি। জন জীবন এখনও বিপর্যস্ত। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে প্রথম সবচেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে ঘুর্ণিঝড় ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই যায়গায় ঠিক কি কি ঘটেছে তা জানার উপায় নেই। সামুদ্রিক ঢেউ নদিবাঁধ ভেঙে দিয়েছে। নোনা জল ঢুকে আগামী কয়েক বছরের জন্য জমি চাষ আবাদের অযোগ্য করে দিয়েছে। সরকারি হিসেবে ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরেও যে কত জন থেকে গিয়েছেন তার কোন হিসেব আছে কি? তাদের কী হয়েছে আমরা জানতে পারবো না । তাছাড়া দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া হুগলী এই পাঁচ জেলায় মাঠের ফসল আর শাক সব্জি সব নষ্ঠ হয়ে গেছে অন্ততঃ যে সব জাগার উপর দিয়ে ঝড়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অঞ্চল গিয়েছে। জমিতে জমে থাকা জল সরিয়ে নুতন করে চাষবাস করে শাক সব্জি ফলাতে আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। হুগলী জেলার কলা ও পেঁপে বাগান নুতন করে তৈরি করতে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। তাই রোজকার খাদ্য তালিকায় শাক সব্জির বিকল্প হিসেবে সয়াবিন, রাজমা, ছোলা, মটর ও অন্যান্য দানা জাতীয় শস্য ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি তাই করি। আলু ও পেঁয়াজ নষ্ঠ হয়নি। তবে আমাদের মধ্যে শর্করা রোগ অনেক বেশি তাই সবার পক্ষে বিকল্প ব্যবস্থা একটু মুশকিল। হুগলী জেলার হিম সাগর ও অন্যান্য আম গছ থেকে ঝরে গেছে। গাছ ফাঁকা। মাত্র একদিন পর জামাই ষষ্ঠী। করোনা জনিত লকডাউন ও ঝড়ের জন্য বিদ্ধস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। গত কালের ঈদের মত জামাই ষষ্ঠীও নম নম করে সারতে হবে। এতে কোন পক্ষ লাভবান হবেন জামাই না শ্বশুর কূল বলা মুশকিল। তবে এটা নিশ্চিত এক পক্ষ লাভবান হলে অন্য পক্ষের ক্ষতি। বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে দুবার কথা না বললেই নয়। এই সময় গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গের উপর দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বইছে গত ছয় দিন ধরে। নিম্নচাপের হাত ধরে আন্দামানে বর্ষা এসেছে ১৭ই মে। ঝড়ের হাত ধরে মনসুন কারেন্ট চলে এসেছে দক্ষিণ বঙ্গের উপর । উত্তর পূর্ব ভারতের উপর থাকা জোরালো পশ্চিমী ঝঞ্ঝার টানে সেই বাতাস ফিরে যেতে পারছে না। অথচ এটা বলার উপায় নেই যে বর্ষা চলে এসেছে। দুদিন পর বাতাসের তীব্রতা কমবে। মনসুন কারেন্ট পিছিয়ে যাবে। ২৮/ ২৯ তারিখ বৃষ্টি হবে গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গেরর কিছু জায়গায়। কেরলেও বৃষ্টি হবে মাসের শেষ কটা দিন। তবে মৌসম ভবন কেরলে বর্ষা আসার কথা কবে ঘোষণা করবে সেটা তারাই ঠিক করবে। উত্তর, উত্তর পশ্চিম, মধ্যে ও পশ্চিম ভারতে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে জুন মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত নয় দিন ধরে একটানা তাপপ্রবাহ ও লু বইতে থাকে। এর স্থানীয় নাম ন’তপা বা নয় দিনের তপন তাপ।এই নয় দিনের প্রবল উষ্ণতা ভালো বর্ষার দ্যোতক বলে প্রচলিত লোক বিশ্বাস। অনেকে মনে করছেন ন’তপা ঐ অঞ্চলে করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সহায়ক হবে।একটা ঘুর্ণিঝড় তৈরি হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর উপকূলের কাছে। আগামী মাসের গোড়ায়। উত্তর পশ্চিম আরব সাগর অঞ্চলে। তা হলেও নাম হবে নিসর্গ। অবশ্য বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। শেষে আমার বাগান কথা। আমার ঢেড়স গাছ ঝড়ে হেলে পড়লেও নষ্ঠ হয়নি। কঞ্চি পুতে গত দু তিনদিনে সোজা করে দিয়েছি। লংকা বেগুন ও তাই। ঝিঙ্গে মাচা হেলে পড়েছিল আজ সোজা করে দিয়েছি। পাট শাক হেলে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু গাছের প্রাণশক্তি যে কতটা প্রবল তার পরিচয় পেলাম আমার এক টুকরো পাট শাকের ক্ষেতে। গাছগুলো নিজের শক্তিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার অন্য বাগানে দুটি পেঁপে গাছ পড়েছে। আম গাছের গোড়া আলগা হয়ে গছে। গাছের ডাল ছেঁটে হাল্কা করে ঠেকনা দিয়ে রেখেছি যাতে কালবৈশাখী ঝড়ে যাতে পড়ে না যায়। এই সব করতে গিয়ে বেশ কিছু ডেঁয়ে পিঁপড়ের কামড় খেতে হয়েছে। প্রকৃতি চলে তার নিজের ছন্দে, নিজের গতিতে, নিজের তাল লয় মিলিয়ে। মানুষ প্রকৃতির সথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে তাকে নিজের নিয়মে চালিত করার নেশায়। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় মানুষের সেটা বুঝতে হবে। নাহলে প্রকৃতি নিজেই বুঝিয়ে দেয় কখনো করোনায় কখনো উমপুনে।
অজয় নাথ
দু’হাত নিচে ওড়ে ধারাবাহিক শোক
এককালে, পশ্চিমে হস্তিনাপুর থেকে শুরু করে গঙ্গানদীর বামদিকের তীর বরাবর যে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি ছিল পূর্বে অরুণাচলের মিশমি পর্বতমালা পর্যন্ত, সেই ঘাসজমিতে তারা হাজারে হাজারে বসবাস করত। তরাই-এর ঘাসজমির পাখি বেঙ্গল ফ্লোরিকান। ‘দ্য গেম বার্ডস্ অফ্ ইন্ডিয়া, বার্মা অ্যান্ড সিলন, ভল্যুম – ১’ (১৮৭৯) বইতে অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম সাহেব পাখিটার কথা প্রচুর লিখেছেন। সেই হিউম সাহেব, যিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে জড়িত আর ব্রিটিশ ভারতের পক্ষীবিদ্যাচর্চার জনক।
আঠারোশো সালের শেষের দিকের কথা। ঘোর ইংরেজ আমল। ভারতীয় উপমহাদেশের পাহাড়, নদী, জঙ্গলের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ব্রিটিশ অফিসারেরা। হিউম সাহেবের সিমলার বাসভবনে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতেন তারা। কোথায় কি পাখির সন্ধান পাওয়া গেলো। আর গুলি করে মারা গেলো। কর্নেল গ্রাহাম নামে এক সাহেব রিপোর্ট দিচ্ছেন “ নর্থ অফ্ মঙ্গলদই, ইন দরং, অ্যাবাউট ফাইভ মাইলস্ ফ্রম দ্য ভুটান হিলস্, অ্যাট এ স্টেজিং বাংলো, ওয়েল নেমড্ শিকার, আই শট্ ফোরটিন ফ্লোরিকান ইন ওয়ান ডে“।
আসামের দরং জেলায় বেঙ্গল ফ্লোরিকান ছিলো খুব পরিচিত পাখি। গ্রাহাম সাহেব দরং জেলায় দিনে তিরিশ থেকে চল্লিশটি ফ্লোরিকান দেখতে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে বলেছেন। কামরূপ ও গোয়ালপারাতে ভালোই দেখা মিলত। নগাঁও, শিবসাগার, লখিমপুরে যথেষ্ট সংখ্যায় তারা ছিল।
মি. ডামান্ট নামে একজন লিখছেন যে গারো পর্বতমালার পাদদেশে ফ্লোরিকান আকচার দেখা যায়। একটা সকালে বন্দুক হাতে বার হলে আট-দশটা মারা কোনো ব্যাপার না। এমনকি তৎকালীন দিনাজপুর ও মালদা জেলাতেও তিনি ফ্লোরিকান থাকার কথা বলেছেন। বাংলায় পাখিটার সুন্দর একটা নামও আছে, ‘ডহর’।
ব্রিটিশ অফিসারদের খাবার টেবিলে বেঙ্গল ফ্লোরিকানের কদর ছিল। হিউম সাহেব লিখছেন “ফ্লোরিকান আর, আই থিংক্, অলমোস্ট দ্য ফ্যাটেস্ট বার্ডস্ ওয়ান ফর শুটস্, অ্যান্ড সার্টেইনলি অ্যামোঙস্ট দ্য বেস্ট বার্ডস্ ফর দ্য টেবল্ উইথ হুইচ ইন্ডিয়া ফার্নিসেস আস্”।
তারপর গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ব্রিটিশ গেছে। ভারতের উত্তর এবং পূর্বের বড় বড় নদীগুলোর ধার ঘেঁষে পিলপিল করে জনবসতি বেড়েছে। ঘাসজমি কেটে কেটে সাফ করে চাষ শুরু হয়েছে বহুদিন আগে থেকে। সেই সাথে কল-কারখানা বেড়েছে। তরাই-এর ঘাসজমি কমতে কমতে প্রায় শেষ। ভারতবর্ষের সমস্ত ‘বাস্টার্ড’ গোত্রে পাখিদের সঙ্গে বেঙ্গল ফ্লোরিকান আজ প্রায় নিঃশেষ। ভারত আর নেপাল মিলিয়ে সম্ভবত পাঁচশোটির বেশি নেই। কম্বোডিয়াতে অন্য একটি উপজাতি (সাব-স্পিসিস ‘ব্লান্ডিনি’) পাওয়া যায়। ভারতে সংখ্যাটা তিনশোর বেশি নয়। মাত্র তিনটে রাজ্যে পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশ, আসাম, অরুনাচলপ্রদেশ। আজ বেঙ্গল ফ্লোরিকান ভারতের অন্যতম দুষ্প্রাপ্য পাখি। সরকারি নিয়ম মোতাবেক বাঘকে যে গুরুত্ব দিয়ে বাঁচাতে হবে বেঙ্গল ফ্লোরিকানকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু তত দিনে যা দেরি হবার হয়ে গেছে।


গত দেড়শো বছরের মধ্যে কেন পাখিটার এই হাল হল তা নিয়ে গত চল্লিশ বছর বেশ কিছু কাজ হয়েছে। সত্যিই কেন ঘাসজমির এই উল্লেখযোগ্য পাখিটা চোখের সামনে প্রায় লোপাট হয়ে গেল? ব্রিটিশরা দায়ী? ঘাসজমি সাফ করে ব্যাপক চাষ-আবাদ কে দোষ দেবেন? নাকি ‘কালের নিয়ম’ ব’লে দায়ভার ঝেড়ে ফেলবেন! মানবসভ্যতা এগোলে কিছু পশুপাখি ধ্বংস হবেই এই তত্ত্বের আড়ালে নিজেকে লুকোবেন? আগে মানুষ, তারপর পশুপাখি।
সত্যিতো, ফ্লোরিকান হারিয়ে গেলে কি হবে! শেয়ার বাজারে ধস নামবে? চুরি বন্ধ হবে? ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে? ভোটবাক্সে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে? উত্তরটা “না”। কিস্যু হবে না। আধুনিক ভারত-আত্মার নির্মাণের কোনো কাজেই বেঙ্গল ফ্লোরিকান লাগেনা। কত পশু-পাখিই তো হারিয়ে গেছে। কি হয়েছে তাতে আমাদের এই দেশটার। চিতা হারিয়ে গেছে। রাজস্থান-গুজরাটের মানুষের কি গিয়েছে-এসেছে! আসামে এখন অনেক সমস্যা। নাগরিক পঞ্জি, উগ্রপন্থা কত কি। সেসব আগে সামলাতে হবে।
আমরা আমাদের মত চলি। যে থাকার থাকলো, যে যাচ্ছে যাক। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পাখিদের প্রভাব (পড়ুন সু-প্রভাব ) প্রমাণ করার মত বাড়তি উদ্যম কোনো কালেই অর্নিথোলজিস্টদের ছিলো না। তাদের সেটাই একমাত্র কাজ বলেও আমি মনে করিনা। সারা জীবন ‘মানব কল্যানে পাখির ভূমিকা’ নিয়ে কাজ করে যাওয়া সম্ভব নয়। আর আজকের জীবনযাত্রায় পাখিদের উপকারিতা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার হিম্মত মানুষের আলবাত আছে। সেই সূত্রে বিভিন্ন পাখির সংরক্ষণের আদৌ কোনো যুক্তি আছে কি? তবে একটা কথা বলা যেতেই পারে যে ভারত-আত্মা শুধু একশ-কুড়ি কোটি মানবসন্তান নিয়ে নয়, প্রকৃতি, বন্যপ্রাণ আরো আরো লক্ষ-কোটি বস্তু দিয়ে তৈরি।
আধুনিক ভারতের যে সাচ্চা ছাত্র পরাধীন ভারত, জাতীয় কংগ্রেস, হিউম ইত্যাদি পড়বে তার চোখ কখনোই এড়োবে না ভারতের পাখির ওপর হিউম ও তার দলবলের কাজের কথা। তৎকালীন ভারতের পক্ষীবৈচিত্রের কথা। সেই ছাত্রের বিশ্বচিন্তায় মানুষ, পরিবেশ ও তার সংকট, জীববৈচিত্র নিশ্চিত ভাবে স্থান করে নেবে। খুব মলিনভাবে হলেও তাই তো হয়ে এসেছে চিরকাল। মানুষ ও সেই সাথে সবাই। ভারত সবার। হিন্দুর, মুসলমানের, গাছপালার, নদীনালার, পশুপাখির। এই চিন্তা মুছে ফেলা যায়নি। আরো গভীরে যদি যাই, আমাদের চলতি অর্থনীতি, সমাজনীতি, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্যপ্রাণ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলতে হবে।
আমি বরং সেইদিকে না গিয়ে বেঙ্গল ফ্লোরিকান পাখিটা কেন উল্লেখযোগ্য, কেন পাখিটার কথা এত আলোচনা হয়েছে চিরকাল সেদিকে নতুন করে দৃষ্টিপাত করি। কারণ প্রজাতি সম্পর্কে জ্ঞান (স্পিসিস নলেজ), আলোচনা, আমাদের প্রজাতিটিকে বুঝতে সাহায্য করে। সচেতন করে। আকৃষ্ট করে। আমাদের ভাবায়। তার নাম আমাদের কানে বাজতে থাকে। তাহলে ভারত কি শুধু আমাদের? আমরা থমকে দাঁড়াই। আর পাখিটার টিঁকে থাকার সপক্ষে কিছু কথা বলে ফেলি। জনমত তৈরি হয়। আদপে তা পাখিটার উপকারে লাগে।
আসামের মানস জাতীয় উদ্যান এই মুহূর্তে বেঙ্গল ফ্লোরিকানের উল্লেখযোগ্য বাসভূমি। অসমিয়ারা “উলু মুরা” নামে পাখিটাকে চেনে। ‘উলু’ একধরনের ঘাস। তরাই অঞ্চলের ঘাস। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইম্পারাটা সিলিন্ড্রিকা’। উত্তর-পশ্চিমে ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত সে ঘাস জমি। ‘মুরা’ মানে ময়ুর। ঘাসজমির ময়ুর।

সেই ঘাসজমির কোথা থেকে, কখন হাউইবাজির মত তার জগৎ-বিখ্যাত লাফ দিয়ে উঠবে কেউ জানে না। মার্চ থেকে জুন সন্তান উৎপাদনের সময়। পুরুষেরা বহুগামী। মেয়েরা আবার সংসারী। ঘাসের আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। পুরুষদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় প্রজননের জন্য। মেয়ে ভোলানোর জন্য ঘাসজমির মধ্যে ঘাড়, গলা, বুকের লম্বা লম্বা পালক ফুলিয়ে সদর্পে হাঁটে কিছক্ষণ।

তারপর হাঁটু ভাঁজ করে দে লাফ। সঙ্গে ডানা ঝাপটানো আর চিৎকার। একলাফে প্রায় তিনতলা সমান উঠে যায়। মাথা থেকে পেট, ফুলিয়ে ঢোল।


নিচে নামে আসাটা প্যারাশ্যুটের মত। ধবেধবে সাদা ডানা দুপাশে মেলে ঝুপ করে নেমে আসে তাদের বাপ-কাকার বসতভিটেতে।

এত কসরত করে মেয়েদের কেউ রাজি হল তো হল, না হলে আবার লাফ। প্রধানত ওই লাফের বাহারের ওপর ঝুলছে ভাগ্য। ওই লাফ পছন্দ হলে তবেই মেয়েটা সম্মতি দেবে। পুরুষেরা তার কম্পিটিটরকে এলাকা-ছাড়া করার জন্য উড়তে উড়তে তাড়া করে। শোনা যায় এই তাড়া করার সময় একজন অন্যজনের লেজ থেকে একগোছা পালক ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। পালক-খসা পুরুষটা হেরো।
মেয়েটাকে তো পাবেই না আর এলাকাও ছাড়তে হবে। দুটি পুরুষ অবশ্য মাটিতেও লড়াই করে। ব্লিথ (ব্রিটিশ ভারতের আরেক নামকরা পক্ষীবিদ ও অফিসার) নামে এক সাহেবকে উল্লেখ করে হিউম জানাচ্ছেন যে ব্লিথ দেখেছেন দুটি পুরুষ সামনে খুব লড়ছে। মানুষের পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই পালালো। তারপর হিউম সাহেবের কথায় “দে রিনিউড দেয়ার কনফ্লিক্ট অ্যাট এ শর্ট ডিস্ট্যান্স, অ্যান্ড দাস্ অ্যালাউড হিম টু ব্যাগ বোথ”। ব্লিথ এই সুযোগে অনায়াসে দুজনকেই গুলি করে মেরে ফেললেন।
হিউম লাজুক পাখিটার বিখ্যাত লাফ-এর বিবরণ দিয়েছেন ওই বইয়ে। খাদ্যাভ্যাস, জীবনচর্যা, সব লিখেছেন। অবশ্য আরো অনেকে গবেষণা করেছেন পরবর্তিকালে। বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি-র বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন পাখিটাকে নিয়ে। তবে ওই লাফই অনন্য করে দিয়েছে পাখিটাকে। ওই লাফের আকর্ষনে বহু পক্ষীপ্রেমী, চিত্রগ্রাহক মানসে যান। আমিও যাই। দেখি সূর্য ডুবে যায় পাহাড়ের কোলে। এপ্রিলের দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সবুজ ঘাসজমি যেন জোকারের স্প্রিং লাগানো বিছানা। প্রায় এক-মানুষ উঁচু ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থেকে কখন, কোথা থেকে তড়াক করে সোজা আকাশে। পায়ের জোরে তিন মিটার স্পটজাম্প। বাইনোকুলার সামনে তাক করে আছি, লাফ দিলো হয়তো পেছন থেকে। তাই অপেক্ষাটাও বেশ মজার। মাঝে মাঝে ছবি তুলি। স্কেচ করি। হিউমের বইয়েও স্কেচ আছে। ছেলেটা ব’সে। মেয়েটা গায়ের কাছে ঘাড় নিচু করে এগিয়ে আসছে। অন্তরঙ্গ মুহূর্ত যেন। আর তো মাত্র তিনশোটা আছে আমাদের দেশে। যেকোনো মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে। একটা ভয়ঙ্কর বন্যা, একটা মাহামারি এই সংখ্যাটাকে মুছে ফেলার পক্ষে যথেষ্ঠ। ভাবি একদিন যদি এমন হয়, সকলের অজান্তে, ভারতের শেষ ‘উলু মুরা’ শেষ লাফটা দিয়ে ফেলে তরাইয়ের ঘাসজমিতে চিরকালে জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের অজান্তে যেমন ‘পিঙ্ক-হেডেড ডাক’ হারিয়ে গেছে। আর আমরা সবাই বোকার মত অপেক্ষা করছি এই বুঝি কোথা থেকে দিলো লাফ। লড়াকু ‘ডহর’। এই ভারতে তার লম্ফঝম্ফ শেষ করেছে। অপেক্ষা শেষ করে আমরা আবার ফিরে গেছি ভোটের লাইনে, টিভির সামনে। বিবিধ নাগরিক বিতন্ডায়। নতুন ভারত তৈরিতে। কবি রণজিৎ দাশ তো লিখেই দিয়েছেন-
“ আমার বাড়ির মাথায় সারাক্ষণ/ একটি পতাকা অর্ধনমিত থাকে/ এতে সুবিধে হয় পাখিদের, আমি দেখি,/ খুঁটির ডগায় বসে তারা অবাধে ডানা ঝাপটায়, যার/ দু’হাত নিচে ওড়ে ধারাবাহিক শোক/……
পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ বন্ধ হলে/ বাতাসের সঙ্গে কালো লংক্লথের বিতর্ক শুরু হয়”।
লেখা, ছবি, স্কেচ – সম্রাট সরকার
Email – samratswagata11@gmail.com
অ্যানিমোমিটার কী? তার প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার
দিনের শুরুতেই খবরের কাগজে বাকি খবরগুলোর আগে অনেকেই আবহাওয়ার খবর দেখেন। প্রযুক্তির যুগে মোবাইলে একটিমাত্র ক্লিক করলে আবহাওয়ার খবর জানা যায়। এই যে আবহাওয়া দপ্তর সমস্ত আপডেট আগে থেকে দিয়ে দেয়, তা কীভাবে দিতে পারে?
তারা এই খবর বা সম্ভাবনা গুলি দিয়ে থাকে বায়ুর গতিপথের উপর নির্ভর করে। আর এই বায়ুর গতিপথ যে যন্ত্রের মাধ্যমে মাপা হয় তার ব্যাপারে আজ আলোচনা করা যাক।
এই যন্ত্রটিকে বলা হয় অ্যানিমোমিটার (Anemometer)
বায়ুর গতিপথের দিক দেখে বহু যুগ ধরেই মানুষ চলার পথ নির্ণয় করে থাকে। এমনকি বহু প্রাণীরাও এমন আছে যারা বায়ুর গতিপথ দেখেই নিজেদের শিকার ধরা কিংবা শিকার হওয়ার থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। আবার বহু প্রাণী নিজেদের চলার পথও নির্ণয় করে থাকে। এই পদ্ধতি গুলি অনুসরণ করি করেই প্রথম যে অ্যানিমোমিটারটি তৈরি হয় তা ইতালিয়ান আবিষ্কারক এবং আর্কিটেক্ট ‘লিওন ব্যাটিস্টা অ্যালর্বাটি‘ এর দ্বারা ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ তে। তখনকার তার এই অ্যানিমোমিটার ছিল একদম প্রাথমিক পর্যায়, খুবই অনুন্নত।
বর্তমান অ্যানিমোমিটার এর সদৃশ প্রথম যে অ্যানিমোমিটারটি তৈরি হয় তারা তৈরি করেন আমেরিকার ‘বিজ্ঞানী জন থমাস রমনে রবিনসন‘ ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে। তার তৈরি অ্যানিমোমিটারটি ছিল আজকের অ্যানিমোমিটারের ক্ষুদ্র সংস্করণ, তাও প্রাথমিক পর্যায়ে।
প্রথমদিকের অ্যানিমোমিটারটি তৈরি হয়েছিল ছোটখাটো কয়েকটি অংশ নিয়ে। তখন এটি অনুন্নত প্রকৃতির থাকায় এটি শুধুমাত্র বায়ুর গতিবেগ মাপা যেত। একটি লম্বা দন্ডের উপরে একটি অর্ধ গোলক বা একটি বাটি কে উল্টো করে বসানো হয়। এরপর এই বাটিটার থেকে ঠিক ১২০° অন্তর বাটির ব্যাস বরাবর ৩ টি ছোট বাটি লাগানো থাকে। এগুলি এমন ভাবে লাগানো হয় যাতে করে ওই ছোট বাটি গুলির মধ্যে বায়ু সঞ্চিত হবার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়। বায়ু প্রবাহের ফলে এই বাটিগুলো নিজের অক্ষ বরাবর ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণন কত তাড়াতাড়ি হচ্ছে সেই পরিমাপ থেকে বায়ুর গতিবেগ মাপা হয়। ১৮৪৬ এর অ্যানিমোমিটারটির গঠন এর সঙ্গে আজকের অ্যানিমোমিটার এর সাদৃশ্য তো আছে কিন্তু এর মধ্যে অনেক কিছু নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে এর থেকে আরো নিখুঁত আবহাওয়ার তথ্য জানা যায়।
প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার
প্রথমেই যেমন বলা হয়েছে অ্যানিমোমিটার আবহাওয়ার অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে। আরো সঠিকভাবে বললে বায়ুর গতিপথ এর অবস্থান নির্দেশ করে। গতিপথের পরিমাপ, অর্থাৎ প্রত্যেক ঘন্টায় কত গতিবেগে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে তা অ্যানিমোমিটার এর মাধ্যমে মাপা যায়। প্রথম থেকে যেসব অ্যানিমোমিটার গুলি ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেগুলি ‘এনালগ’ প্রকৃতির। তবে এখন ডিজিটাল রূপে অনেক অ্যানিমোমিটার ব্যবহার করা হয়। যার ফলে গতিবেগের পরিমাপ আর নিখুঁত ভাবে পাওয়া যায়। যদিও এর মূল গঠন-প্রকৃতি একই আছে,খালি কিছু অংশ কে আগের চেয়ে উন্নত করা হয়েছে।
যেকোনো অঞ্চলের আবহাওয়া নির্ভর করে বায়ুর প্রকৃতির উপর। সেখানকার শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা বায়ুর গতিপ্রকৃতির ওপরনির্ভরশীল। নিম্নচাপ, উচ্চচাপ এই সমস্ত ধরনের বায়ুর অবস্থার পরিমাপ এই যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়। ভারতে যেমন মৌসুমী ঢুকলে তবে বর্ষা শুরু হয়। সেই মৌসুমী বায়ু ঠিক কখন কোন অঞ্চল দিয়ে কতটা বেগে প্রবেশ করে সেটাও আমাদের আবহাওয়াবিদরা অ্যানিমোমিটার এর সাহায্যে জানতে পারেন। আবার শীতের পূর্বে ঠিক কখন সাইবেরিয়ান শীতল বায়ু প্রবেশ করার চেষ্টা করে সেটিও এর মাধ্যমে জানা যায়।
আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করেই কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফসলের চাষ শুরু হয়। বৃষ্টির অবস্থা, গরমের পরিমাণ কি ধরনের হতে পারে তা এই বায়ুর প্রবেশ দেখে কিছুটা নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন সঙ্কটের মুহূর্তগুলি, যেমন বড় সামুদ্রিক ঝড় গুলির সম্বন্ধে আগে থেকে জানা যায়। ঝড়ের গতিবেগ এর উপর নির্ভর করে জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া না যাওয়া নির্ণয় করা হয়। বায়ুর গতিবেগ বিপদসংকুল অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে এরকম মনে হল সামুদ্রিক যাত্রা ব্যাহত করা হয়। এমনকি সমুদ্রে স্নান করতেও নিষেধ করা হয়।
বহু যুগ ধরে এভাবেই বড় জাহাজ গুলিতে সামুদ্রিক যাত্রার সময় অ্যানিমোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুর দিক নির্ণয় এবং ঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে যাত্রা করা হত। যার ফলে বহু জাহাজ বড় ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আবহাওয়া দপ্তরের হাতে উন্নত যন্ত্রপাতি চলে আসুক না কেন, অ্যানিমোমিটার এর ব্যবহার সর্বদাই প্রয়োজনীয়। অন্তত এর কার্যকারিতার বিষয়টি কেউই অস্বীকার করতে পারবে না।
–সৌরদীপ কর্মকার